আমাকে কি বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবি বাবা ?
পৃথিবীটা কিছু কিছু মানুষের জন্য খুবই কঠিন। তাদের প্রাণ-টাকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যেতে হয়, অাবার অনেকক্ষেত্রে সেই যুদ্ধের ধরণটাও খুব নির্মম। অাজ সেরকম একজন যোদ্ধার কথা শুধুমাত্র অাওয়ার নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি ।
সায়রা বেওয়া। বয়স সত্তর বা তার কিছু বেশী । ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজনের পর ভারতের বিহার থেকে সপরিবারে চলে অাসেন নীলফামারীর সৈয়দপুরে, বসতি হয় বাঙ্গালীপুরস্থ ৭নং স্টান্ডার্ড পাকিস্তানীজ ক্যাম্পে । বাবা ছিলেন দিনমজুর, মা ছিলেন গৃহিণী। সংসারে অার্থিক সচ্ছলতা না থাকায় সায়রা বেওয়ার মা সাংসারিক কাজের ফাকে ইট ভাঙ্গার কাজ করতেন । তখন সায়রা বেওয়ার বয়স ছিল ১০-১২ । মাকে সাহায্য করতে তিনিও মায়ের সাথে ইট ভাংতেন।
অাধা কেজি ওজনের হাতুরী দিয়ে প্রত্যেকদিন সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইট ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার অাপ্রাণ চেষ্টার মাঝে কেটে গেছে অনেকদিন । সায়রা বেওয়ার বিয়ে হয়, পর্যায়ক্রমে কোলে অাসে ৫টি ফুটফুটে সন্তান । সায়রা বেওয়ার স্বামীর অার্থিক সচ্ছলতা থাকায় ইটের মধ্যে হাতুরীর অাঘাত কিছুদিন বন্ধ ছিল। কিন্তু এরই মাঝে সঠিক চিকিৎসার অভাবে তার দুই সন্তান মারা যায় । ঠিক তার বছর পাচেক পর সায়রার স্বামী না ফেরার দেশে চলে যায় ।
কষ্টের দিন যেন অার শেষ হয় না!
অাবার সায়রা বেওয়ার সংগ্রামী জীবনের শুরু, বেচে থাকা অন্য তিনটি সন্তানকে নিয়ে বেচে থাকার তাগিদে সায়রা অাবার হাতে তুলে নেয় হাতুরী ।
অাটকেপড়া পাকিস্তানী হওয়ায় তার সাথে বিভিন্নভাবে খারাপ অাচরণ করা হয়, মজুরি বৈষম্য তো ছিলই ।
এভাবেই কষ্টের মাঝে তিল তিল করে বড় করতে থাকেন বুকের ধন তিন ছেলেকে । একসময় ছেলেরা বড় হয়, উপার্জন করতে শেখে । সায়রা বেওয়া মনে মনে সুখভাব অানে,ছেলেদের কামাই খাওয়ার তৃপ্তিময় স্বপ্ন দেখে । সে মনে করে এই বুঝি তার কষ্টের দিন শেষ হল । কিন্তু না, তার কষ্ট শেষ হয় না ।
সে যাদের এত কষ্ট করে মানুষ করল অাজ তারা বিয়ে করেছে । সায়রার বড় ছেলের বয়স (৪২) , পেশায় বাবুর্চি । অন্যের অানন্দের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে বিভিন্ন মুখরোচক খাবার রান্না করলেও নিজের মায়ের চোখাশ্রু মুছে মুখে দুমুঠো ভাত তুলেল দেয়ার মত বয়স তার এখনও হয়নি । বড় ছেলের মত রাজমিস্ত্রি মেজো ছেলে (৩৪) অার ট্রাকের হেলপার ছোট ছেলের (২৭) বোধোদয়ও হয়নি ।
তাইতো জীবনের পড়ন্ত বেলাতে এসেও সায়রা বেওয়ার অাধা কেজি ওজনের হতিুরীটি তুলে রাখা সম্ভব হয়নি ।
অামাদের এই প্রতিবেদককে সায়রা বেওয়া অশ্রুসিক্ত চোখে জানান, বাবা অামি ৬০ বছর ধরে এই খোয়া (ইটের টুকরা) ভাঙ্গি, যখন কাজ শুরু করছি তখন ১অানা মজুরী ছিল । এখোন তো ১০০ রুপিয়া (টাকা) পাই । এখোন বয়ছ (বয়স) হইছে বাবা, অাগের মত খোয়া ভাংতে পারি না।
একটু ঠান্ডা-গরমের কমবেশী হইলেই অসুস্থ হয়ে যাই । তখন কাজে অাসতে পারি না, তাই পেটে খাবারও যায় না ।
অাপনার ছেলেরা তখন অাপনাকে খাবার দেয় না! বললে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
বাবা, ওরা ভাল খাউক, ভাল থাউক ।
অামি ওদের কাছে কিছু চাই না, ওদের যদি কম হয়ে যায়!
তিনি চোখ মুছতে মুছতে জানতে চান, বাবা, মানুষ অার কত গরীব হইলে, কত বছর বয়স হইলে বয়স্ক ভাতা পায়!
নিজে কামাই করলে চিকিৎসার খরচ অামি করি, কাপড় পড়ি । কামাই না করলে…
তিনি ব্যস্ততার সুরে বলেন, বাবা, তোমার সাথে কথা কইলে অামার কামাইয়ের টাকা পাব না ।
অাকুতির সুরে বলেন, কাম করলে তখন অামি খাইম বাবা,না করলে অামাক না খায়া থাকতে হবে ।
এদিকে খোজ নিয়ে জানা যায়, তিনি বিধবা ভাতা/ বয়স্ক ভাতা,ভিজিএফ সাহায্য সহ কোন ধরনের সরকারী সাহায্য পান না ।
এব্যাপারে সৈয়দপুর পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোসলেম উদ্দিনের সাথে অাওয়ার নিউজ বিডি’র পক্ষে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সাধারণত ৬৪ বছর বয়স হলে একজন মহিলাকে বিধবা ভাতা সহ বয়স্ক ভাতা ও অন্যান্য সাহায্য দেয়া হয় ।
অামাদের প্রতিনিধি যখন জানতে চান, সায়রা বেওয়া তো সত্তরোর্ধ! তখন তিনি এ ব্যাপারে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি ।
একপর্যায়ে তিনি বলেন, অামার কাছে চারটা কার্ড (বয়স্ক/বিধবা ভাতা) অাছে ।
অামি যেন অাজকেই তার কাছে সায়রা বেওয়াকে পাঠিয়ে দেই, তা না হলে উনি কাল লিষ্ট জমা দেবেন । পরে অার হবে না ।
তখন তাকে বলা হয়, জনপ্রতিনিধি হিসেবে এই দায়িত্বটা তো অাপনার!
শেষে সায়রা বেওয়ার জন্য যে কথাটি দুঃখের সাথে বলতে হয়-
ওহে সায়রা, বুকের রক্ত পানি করে তুমি যাদের মানুষ করলে তারা যেমন তোমার কোন উপকারে অাসে না, ঠিক তেমনিভাবে একরাশ বিশ্বাস নিয়ে ভোট দিয়ে যাকে জনপ্রতিনিধি বানালে সেও তোমার কোন কাজে অাসছে না । কারণ একটাই, সেটা সায়রা নিজের মুখেই বলেছেন, বাবারে, কিছু কিছু মানুষের জন্মই হয় শুধু কষ্ট করার জন্য । অামিও তাদের মধ্যে একজন । বাবা তুই তো সংবাদিক (সাংবাদিক), অনেক জায়গা চিনিস । যখন অামি এই হাতুরীটা অার তুলতে পারব না তখন অামাকে একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে অাসবি বাবা!
অামি অশ্রুভেজা কন্ঠে উত্তর দিয়েছি, হ্যা ।
মন্তব্য চালু নেই