ডিমলার ঐতিহ্যবাহী কামাত ভাতি এখন বিলুপ্তির পথে

হামিদা আক্তার, নীলফামারী থেকে : ঠুক ঠাক, ঠুক ঠাক শব্দে মুখরিত কামারপাড়ায় এখন আর এসব শব্দ তেমন একটা শুনা যায় না। ইঞ্জিন চালিত মেশিনে তৈরী করা হয় কামারের বানানো গৃহস্থালির নিত্য প্রয়োজনীয় লোহা দিয়ে তেরী দা ,কুড়াল ও কাঁস্তে। কামারপাড়ায় কামাত ভাতিতে কয়লা পুড়িয়ে আগুনের লেলিহান শিখা বের করে আর সেই আগুনে লোহাকে গলিয়ে তৈরি করা হত এসব লোহার নিত্য প্রয়োজনীয় দা, বাইশলে ও কুড়াল। কামারদের বাহুর শক্তিতে হাতুরী দিয়ে পিটিয়ে লোহা গলিয়ে বানানো হত লোহার জিনিস। কিন্তু কালের পরিবর্তনে দেশে এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলীন হতে চলেছে কামারদের কামাত ভাতির কারখানা। এক সময় তাদেরই হাতে লোহার তৈরী গ্রহস্থালীর জিনিসগুলি ব্যাবহৃত হত প্রতিটি পরিবারে। ফলে এসবের চাহিতাও ছিলো ব্যাপক। কিন্তু কালেই এখন অকাল হয়েছে। বদলে গেছে গ্রামের সেই দিনগুলি।

কামারপাড়ায় বাব-দাদার আমলে হাতে খড়ি হিসেবে পাওয়া এমনকি গোষ্ঠির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতেই এখনও কলুর বলদের মত খেটেই যাচ্ছি। লাভ তেমন একটা হয় না। বিক্রিও বেশী নেই। মানুষ এখন আর কামারদের তৈরী লোহার জিনিসগুলি ব্যাবহার করতে চায় না। কিন্তু কি করবো ? বংশ পরমপরায় এ বিদ্যা টিকিয়ে রাখতেই ধরে রেখেছি কামাত-ভাতির এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি। কথাগুলি বলছিলো নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের দোহলপাড়া গ্রামের মৃত সবীন্দ্রনাথ কর্মকারের পুত্র রবীন্দ্র নাথ কর্মকার।

তিনি বলেন, গৃহস্থলির কাজে ব্যবহৃত নিত্য দিনের একটি অস্ত্র দাঁ ও বটি। সেটিও এখন অচল। আমাদের কামাত ভাতিতে হাতুরী পিটিয়ে তৈরি করা এসব নিত্যদিনের জিনিসপত্র ছাড়াও তৈরী করা হয় জিনিস দাঁ-বটি, কুঠার-ছুঁরি, শাবল-নিড়ানী, কাস্তে-কোঁদাল নানা রকমের অস্ত্র। সেই ছোট্ট বেলায় বাবার সাথে কাজ করতে করতে শিখেছি এসব তৈরী করতে হয় কিভাবে। বলতে পারেন বাবার কাছেই হাতে খড়ি। তাছাড়াও শিখেছি গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সেই পুরনো দিনের ঐতিহ্য ভোঁতা পাথরের তৈরি বিভিন্ন প্রকার শিকার অস্ত্র। খোজ খবর নিয়ে জানা গেল, সভ্যতার বিবর্তন সাথে সাথেই পরিবর্তিত হয়ে চলেছে সব কিছুর। সে সময়ের ঐহিত্যবাহী জিনিসগুলি এখন অনেকটাই স্থান করে নিয়েছে যাদু ঘরে।

ঐহিত্যবাহী শিল্পগুলি এখন শুধুই স্মৃতি। গ্রামীণ জনপদে গ্রামাঞ্চলের মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় এই সকল জিনিস ব্যবহৃত হত বেশির ভাগ ক্ষেত-খামার ও গৃহাস্থালির কাজে। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রায় বিলুপ্তির পথে এই শিল্পটি বলে জানান, কামারপাড়ার কারীগড়রা। এসব কামারেরা কথার ছলে বলেন ‘‘শিখলে শেখ সাপের মন্ত্র, না হয় বাবার শাস্ত্র’।

তারা জানায় ছোট বেলায় খেলার ছলে ভাতী টেনে কয়লা পুড়িয়ে লোহাকেও লাল করে হাতুরীতে পেটিয়েছি। পিটিয়ে পিটিয়ে আগুনে তৈরিকৃত অস্ত্রগুলি জলে ভিজিয়ে রেখে জ্বর সাড়াতাম। দাদা-দাদাীর কাছে শুনেছি হাতুরী পিটালে লোহার তৈরী কাস্তের গায়ে জ্বর আসে। আর পানিতে ভিজিয়ে রাখলেই সে জ্বর পালাতো। কিন্তু কি করবো কাজ করে পারিশ্রমিকটাও এখন তোলা সম্ভব হয় না অনেক ক্ষেত্রে।

কারন হিসেবে তারা দেখালো, দেশের আনাচে কানাচে এখন গড়ে উঠেছে ওয়ার্কশপ লৌহ শিল্পের যালাই কারীগর। গ্রামগঞ্জের হাট বাজার বন্দরে এখন তাদের তৈরীকৃত দাঁ-বটির কদর অনেকাংশেই বেশি। আর সেই সব ক্রয় কৃত জিনিসপত্র গুলি শুধুমাত্র সানিয়ে নিতেই আসে আমাদের কাছে। তবে আমন-ইরি-বোরো ফসল কাটতে কাস্তে সানার ধুম পড়ে আমাদের কামার শালায়। অন্যদিন গুলোতে কাজ খুব কম বললেই চলে। বিভিন্ন কারণে বিলুপ্তির পথে গ্রাম্য কামারশালা গুলি।

এক সময় আমাদের এই কামার পাড়ায় অনেক কারিগড় ছিলো এখন অনেকেই এ কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্যকাজে যুক্ত হচ্ছে। তাই এখন আর কামারপাড়ার নেই আগের মত ঠুক ঠাক শব্দ। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি নিয়ে একান্তে কথা হয় খগাখড়িবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথনের সাথে সব কছিু শুনে তিনি বলেন,আমাদের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি আমাদের প্রয়ো জনেই বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।

আমাদের জীবন সংসারের অবিছেদ্দ একটি অংশ। এটি যেন বিলিন হয়ে না যায় সে দিকে দৃষ্টি রাখা সকলের উচিত। এ সময় উক্ত ইউপি’র সদস্য রুহুল আমিন বলেন, এ শিল্প আমাদের অহংকার, যার তৈরিকৃত সামগ্রী নিত্য দিনের সঙ্গী।



মন্তব্য চালু নেই