অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে আলোর পথে বর্ণা আক্তার

খাদেমুল মোরসালিন শাকীর, কিশোরগঞ্জ (নীলফামারী) প্রতিনিধি॥ বয়স যখন ১৩ বছর ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী পারিবারিক ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখতে বিয়ে দেয়া হয় বর্ণা আক্তারকে। সবকিছু ফেলে সংসার করতে হয় বর্ণা আক্তারকে। দেড় বছরের মাথায় একটি সন্তানের মা হয় বর্ণা আক্তার। সন্তানের নাম মোঃ মুন্না হোসেন। সেও আবার প্রায় বাক প্রতিবন্ধী।

বর্ণা আক্তার ২০০০ সালে জন্ম গ্রহন করেন কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম দলিরাম বৈত্যপাড়া গ্রামে। তার পিতা সবুজ আলী একজন শেলাই মেশিনের মেকার। মা গৃহিনী। কোনমতে চলে বর্ণার বাবার সংসার। বর্ণার সন্তান মুন্নার চিকিৎসার জন্য রংপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা সেবা নেয়া হচ্ছে। মুন্নার বর্তমান বয়স ২ বছর। বর্ণা নিজে একটি শিশু সন্তান তার পরেও তার একটি বাক প্রতিবন্ধী শিশু সন্তানের জন্ম দেয়ায় বর্ণার জীবনে নেমে আসে এক অমানিষার কালো অন্ধকার। সংসারে শুরু হয় সম্পর্কের টানা পোড়েন। ৪ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে বর্ণা আক্তার বড়। বর্ণা আক্তার যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে ঠিক সে সময় তার আপন ফুফু বর্ণা আক্তারের বাবা সবুজ আলীর সাথে পারিবারিক ভাবে মনোমালিন্য হয়।

সম্পর্কের দূরত্বকে কাছে টানতে ব্যবহার করা হয় বর্ণা আক্তারকে। বর্ণাকে তার ফুফু প্রায় সময়ে তার বাড়ীতে নিয়ে যেত। বলতো বর্ণার সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিলে ঠিকই ভাই বোনের সাথে সম্পর্ক গভীর হবে। তারপর কৌশল করে বর্ণার সাথে বিয়ে দেয়া হয় ফুফাতো ভাই সাদ্দাম হোসেনের সাথে। বর্ণা আক্তারের আপন ফুফাতো ভাই সাদ্দাম হোসেনের সাথে ২০১৩ সালের শেষের দিকে বিয়ে হয় বর্ণা আক্তারের। কিছুদিন সংসার ভাল ভাবে চললেও যৌতুকের ভয়াল গ্রাসে নির্যাতনের ষ্টিম রোলার চালানো হয় বর্ণার উপরে। বাবার কাছ থেকে যৌতুকের টাকা নিয়ে আসার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে তার ফুফু ফুফা ও স¦ামী।

বর্ণাকে তার আপন ফুফু ও তার স্বামী (ফুফাতো ভাই) সাদ্দাম হোসেন প্রতিনিয়ত শারিরীক ও মানসিক ভাবে নির্যাতন চালাতো। দিনে দিনে অত্যাচারের সীমা বাড়তে থাকে। নিরূপায় বর্ণা আক্তারের শশুর,শাশুড়ী ও স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর তার স্বামী সাদ্দাম হোসেনকে তালাক দিয়ে শিশু সন্তান মোঃ মুন্না হোসেনকে তার বাবার বাড়ীতে নিয়ে আসেন। অন্ধকারের গহীনে চলে আসে বর্ণার জীবন। হঠাৎ করে তার অমানিশার কালো আধারকে আলোয় পরিণত করতে গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের দলিরাম এলাকায় কিছু উদ্যমী যুবকের মাধ্যমে গড়ে ওঠা শ্রম কল্যাণ পাবলিক পাঠাগারের সদস্যরা তার পাশে দাড়ায় এবং পূর্বের জীবনে ফিরিয়ে আনতে তাকে উৎসাহ প্রদান করে। বর্ণা আক্তার শিক্ষা জীবনে ৫ম শ্রেণীর সমাপনি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্ব লাভ করেন।

শ্রম কল্যাণ পাবলিক পাঠাগারের সদস্যদের প্রচেষ্টায় আবারো পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হয় বর্ণা আক্তার। গত বছর ২০১৬ সালের জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বর্ণা আক্তার ৮ম শ্রেণীতে গোল্ডেল এ প্লাস লাভ করেন। শিশু সন্তানকে পরিচর্যার পাশাপাশি বাবা সবুজ আলীর সংসারে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে সে। গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের শরীফাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী জানান,বর্ণা আমাদের গৌরব। তার চেষ্টার কারণে সে জেএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। স্বামীর সংসারকে ছুড়ে ফেলে বর্ণা আক্তার নিজের জীবন গড়তে শুরু করেছে।

বর্ণা আক্তারের পাশে দাঁড়াতে শ্রম কল্যাণ পাবলিক পাঠাগারের সভাপতি তৌফিকুল ইসলাম মিশুক ও সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন ইমু বিত্তবান এবং সরকারকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেছেন। বর্ণা আক্তারকে প্রতিমাসে শরীফাবাদ স্কুল ও কলেজের সহকারী শিক্ষক অনন্ত কুমার ও সহকারী শিক্ষক সোহাগ হোসেন বিনা অর্থে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। শরীফাবাদ স্কুল ও কলেজের সহকারী শিক্ষক অনন্ত কুমার বলেন,বর্ণার পড়ালেখার জন্য খাতা কলম,বইসহ অন্যান্য সুবিধা কেউ না দিলে আমি সার্বিক সহযোগীতা করবো।

শরীফাবাদ স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তাফিজার রহমান বলেন,বর্ণা আক্তার আমাদের জন্য গর্বের। সে আমাদের অনেক শিক্ষার্থীকে আলোর পথ দেখাবে। তার জীবনে যে ঝড়টুকু বয়ে গেছে সে সবকিছুকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিজের জীবন গড়তে শুরু করেছে। আমার পক্ষ থেকে তার জন্য সহযোগীতা অব্যাহত থাকবে। বর্ণা আক্তারের বাবা সবুজ আলী জানান আমার ভুলের কারণে আমার মেয়ের জীবণ নষ্ট হয়ে গেছে। সে আবার পড়ালেখা শুরু করেছে আমার শেষ শক্তি দিয়ে হলেও তার পড়ালেখার খরচ চালাবো।

বর্ণা আক্তারের সাথে কথা হলে সে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন,আমি আমার জীবনকে নতুন করে সাজাতে চাই। আমি পড়ালেখা করে সমাজের মানুষকে জানাতে চাই বাল্য বিবাহের কুফল কি? আমার ফুফু ফুফা ও আমার তালাকপ্রাপ্ত স্বামী আমার উপর অমানুষিক শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতনে আমাকে এবং আমার সন্তানকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আজ আমার বিপদের পাশে আমার ছাতা হিসাবে শ্রম কল্যাণ পাবলিক পাঠাগারের সকল সদস্যরা আছেন।

আমি অন্ধকার জগত পেরিয়ে আলোর পথে এগিয়ে যেতে চাই। সে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন,আমার গরীব বাবা ৪ বোন ১ ভাইয়ের সংসার কোন মতে চালাচ্ছেন। সেখানে আমার শিশু সন্তানের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক মাসে প্রায় ২ হাজারেরও বেশী টাকার দরকার হয়। যা আমার বাবার পক্ষে বহন করা খুবই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। বর্ণা তার সন্তানের জন্য এবং তার পড়ালেখার জন্য দেশের মানুষের কাছে দোয়া চেয়েছেন।



মন্তব্য চালু নেই