কিশোরগঞ্জে বুল্লাই নদীর উপর দিয়ে চলাচল কারীদের এখন শেষ ভরসা কলার ভেলা
একটি সেতুর অভাবে চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন কিশোরগঞ্জ উপজেলার চার ইউনিয়নের প্রায় ৫০হাজার মানুষ।
উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বুল্লাই নদীর উপর চলাচলের জন্য অস্থায়ী ভাবে স্থাপিত একমাত্র মাধ্যম “বাঁশের সাঁকোটি” পানির স্রোতে বিলিন হয়ে যাওয়ায় ভরা বর্ষায় বিপাকে পড়েছেন দশটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত ধরেয়ার বাজার সংলগ্ন নাউয়ার ঘাটের পুর্ব-পশ্চিমে মাত্র ৬০ মিটার সেতু নির্মাণ না হওয়ায় ভরা বর্ষায় কলার গাছ দিয়ে বানানো ভ্যালা দিয়ে নদীর ঘাট পাড়াপাড় হচ্ছেন পথচারীরা।
গত বছর নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীব্র স্রোতে ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তায় স্থানীয়দের উদ্যোগে অস্থায়ী ভাবে স্থাপিত বাঁশের সাঁকোটি ধ্বসে পড়ে। তারপর থেকে বাঁশের সাঁকো না থাকলেও তবিবর রহমান, সাহাবুল হোসেন, জোনাব আলী ও জোগেশ চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে কলার ভ্যালা বানিয়ে পাড়াপাড় করানো হচ্ছে চলাচলকারীদের। ওই পথ দিয়ে যাতায়াত কারী হাজার মানুষের এখন একমাত্র ভরসা “কলার ভ্যালা”।
ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য মোশাররফ হোসেন জানান, বুল্লাই নদীর উপর দিয়ে নাউয়ার ঘাট ব্যবহার করে প্রতিদিনই যাতায়াত করেন গাড়াগ্রাম ইউনিয়ন ছাড়াও রণচন্ডি, পাশ্ববর্তি গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ও নোহালী ইউনিয়নের মানুষ।
তিনি জানান, সাইকেল নিয়ে ভুড়া(কলার ভ্যালা) অতিক্রম করা গেলেও রিকসা, ভ্যান, মটর সাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করছে ৫/৬ কিলোমিটার পথ ঘুরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৯০’র দশকে স্থানীয় সরকার বিভাগ ২৮লাখ টাকা ব্যয়ে সেখানে একটি মিনি ব্রীজ নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও পরবর্তিতে মিনি ব্রীজ নির্মাণ প্রকল্প বাতিল হওয়ায় আর সেখানে হয়নি প্রত্যাশিত ব্রীজ।
স্থানীয়দের অভিযোগ ভোটের আগে মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমপিরা প্রতিশ্র“তি দিলেও আদৌ বাস্তবায়ন করতে পারেন নি তাদের ভোটের আগে দেয়া প্রতিশ্র“তি।
ওই পথ দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী দক্ষিণ সোনাকুড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী আরফিনা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, আমার বাবা গরিব মানুষ। ভুড়া(ভ্যালা) দিয়ে যাওয়া আসার পথে দু’বার মিলে ৫টাকা দিতে হয়। সাতাঁর না জানায় ভয় ভয় করে ভুড়ায় চড়ে অতিক্রম করতে হয় ঘাটটি। রণচন্ডি স্কুল এ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্রী হেলালী আখতার বলেন, ভুড়ায় চড়ে পাড়াপাড়ের সময় পানির স্রোতে দিক হারিয়ে যায় ভুড়াটি। চলাচলের একদিন ভুড়া থেকে পড়ে বই পত্র ভিজে ফেলি।
দক্ষিণ সোনাকুড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মহিদুল ইসলাম জানান, বুল্লাই নদীর ওই ঘাট ব্যবহারকারী আশপাশের প্রাইমারী, হাইস্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা মিলে দশটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী যাতায়াত করে প্রতিদিন। দীর্ঘদিনেও ব্রীজ নির্মাণ না হওয়ায় আসা যাওয়ার কারণে স্কুলে উপস্থিতি কম হওয়ার পাশাপাশি লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা।
নিজ উদ্যোগে কলার ভ্যালা বানিয়ে সেবাদানকারী চারজনের মধ্যে তবিবর রহমান ও হাবিবুল ইসলাম জানান, ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগীতায় বাঁশের সাঁকো বানানো হলেও তীব্র পানির স্রোতে সেটি ধ্বংস হয়ে যায়।
বাধ্য হয়ে আমরা চারজন মিলে কলার গাছ গিয়ে ভুড়া(ভ্যালা) বানিয়ে পাড়াপাড় করে দিচ্ছি মানুষদের।
এ জন্য কেউ ২টাকা, কেউ ১টাকা কেউবা ৫টাকাও দেন। দিনে পানির স্রোত কম থাকলে একজন এবং বেশি থাকলে দুইজন মিলে ভুড়া চালাই। দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা উপার্জন হয় বলেও জানান তিনি। তবে পানির স্রাতে দিক হারিয়ে অনেক সময় অন্য স্থানেও সরে যায় ভুড়াটি। সে সময় অনেক শক্তি ক্ষয় করে ঘাটের কোনায় নিতে হয় ভুড়াটিকে।
উন্নয়ন কর্মী ও শ্রম কল্যান পাবলিক পাঠাগারের সভাপতি তৌফিকুল ইসলাম মিঠু জানান, ঝুঁক নিয়ে ভুড়ায় চলাচল করায় সবচেয়ে বেশি আতংকে রয়েছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। তারা সাঁতার না জানায় অনেক সময় নদীতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাছাড়া পাড়াপাড় হতে গিয়ে বই পত্র ভিজে নষ্ট হয়েছে অনেকের।
গাড়াগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিপ্লব কুমার সরকার জানান, মাত্র ৬০মিটারের একটি সেতু হলে ভোগান্তির লাঘব হবে আশপাশের চারটি ইউনিয়নের মানুষের। ৯০’র দশকে স্থানীয় সরকার বিভাগ সেতু তৈরির জন্য তিনটি পিলার স্থাপন করলেও আলোর মুখ দেখেনি সেতুটি। মিনি ব্রীজ প্রকল্প বাতিল হওয়ায় সেখানে আর কাজ শুরু হয়নি সেতুটির।
তবে তিনি বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার পর ত্রাণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা হলেও এলজিইডি সেখানে উদ্যোগ নেওয়ায় জায়গা পরিবর্তন করে অন্যস্থানে ত্রাণের সেতুটি নির্মাণ করা হয়। তবে এ নিয়ে সংসদ সদস্যের মাধ্যমে তদবির চালানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কিশোরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশল দফতরের প্রকৌশলী এস এম কেরামত আলী নান্নু জানান, বুল্লাই নদীর উপর নাউয়ার ঘাটসহ অন্য স্থানের আরো দুটি মিলে তিনটি সেতুর জন্য প্রকল্প তৈরি করে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে খুব শীঘ্রই সেখানে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।
তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এতদিনেও সেখানে সেতু নির্মাণ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন নীলফামারী-০৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বিরোধী দলীয় হুইপ আলহাজ শওকত চৌধুরী।
তিনি জানান, আমি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সেতু নির্মাণের জন্য তদবির করছি এলজিইডিতে। আমার ডিও লেটারও দেয়া রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংসদেও বলেছি কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না।
আবারো দৌড় ঝাঁপ করে দ্রুত সেখানে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেবেন বলে জানান তিনি।
মন্তব্য চালু নেই