সহিংসতার শিকার হয়ে রামেকে ১মাসে ৪৮জন ভর্তি

দেশব্যাপী চলছে জ্বালাও-পোড়াও নাশকতা। এর হাত থেকে রেহায় পাচ্ছেনা শিশু বৃদ্ধ কেউই। গত ৫ জানুয়ারি থেকে রাজশাহীসহ সারাদেশে লাগাতার হরতাল ও অবরোধ চলছে। নাশকতার শিকার হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে গত ১মাসে ৪৮ জন ভর্তি হয়েছেন। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। এদের মধ্যে আইসিইউতে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিলো।

গত ২ ফেব্রুয়ারি সোমবার ৯টার দিকে মহানগরীর লিলিহল এলাকায় একটি বালু ভর্তি ট্রাকে আগুন দিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। এতে ট্রাকের ড্রাইভার ও হেলপার দগ্ধ হয়েছেন। রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আহতরা হলেন, ট্রাক চালক রাজশাহীর আলীগঞ্জ এলাকার সাইদুর রহমান (৪৫) ও পবার মোল্লাপাড়া এলাকার শহিদুল ইসলাম (৪৪)। ট্রাক চালক সাইদুর রহমানের শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে ও শহিদুল ইসলামের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। একই দিনে,

রাত সাড়ে নয়টার দিকে নগরীর বড় বনগ্রাম একটি খালি ট্রাকে আগুন দিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। ট্রাক চালক ফারুক হোসেন দগ্ধ হয়। তিনি রাজশাহীর মুসরইল জলিলের মোড় এলাকার আমজাদের ছেলে। ডাক্তার বলছে, তার শরীরের ৬শতাংশ পুড়ে গেছে।

ফারুক হোসেন গত দুই মাস থেকে এনজিও থেকে নেয়া ঋণ দিয়ে সংসার চালাচ্ছি। ভাই আপনারাই বলে দেন আমি কী করবো? পরিবারের মুখে কে ভাত তুলে দেবে? এসব প্রশ্ন ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচিতে ছোড়া পেট্রোলবোমায় দগ্ধ ট্রাকচালক ফারুক হোসেনের।

মঙ্গলবার বোমার আগুনে দগ্ধ ফারুক হোসেন এখন রামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভর্তি রয়েছে। ফারুকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। ফারুকের মুখ, দুই হাত ও শ্বাসনালী কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনায় ফারুকের ৫শতাংশ পুড়ে গেছে।

বার্ন ইউনিটের বিছানায় শুয়ে থাকা ফারুক অনেক কষ্ট করে কথা বলছিলেন। তিনি জানান, পরিবারে তার স্ত্রী রানী ও দুই মেয়ে শান্তনা (১২) ও নদী (৫)। বড় মেয়ে শান্তনা ইউসেফ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। ছোট মেয়ে নদী সবে স্কুলে যাওয়া শিখছে। সংসারে অভাবের কারণে এনজিও থেকে ঋণ নেয়া ছিল। সেই টাকা দিয়েই সংসার চলছিল। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখন কী হবে। আমার কারণে পরিবার পথে বসে যাবে।’
ফারুক হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ট্রাকে হেলপারের কাজ করছি। মাঝে ব্যাকার। কোনো কর্ম না পাইয়া শ্যাসে এক মাস আগে ট্রাকে উঠছি। সাইদুর ভাইয়ের (ওই ট্রাকের আরেক চালক) হাত ধরে ট্রাকে উঠছিলাম। ট্রাক চালাতে শিখছি। আশেপাশের ভাড়াগুলান আমি মারি।’
মঙ্গলবার সকালে ট্রাক মেরামতের জন্য নগরীর খানকার মোড়ে গ্যারেজে নিয়ে আইছিলাম। গ্যারেজ কাছে থাকায় একা ওই দিন রাত আটটায় ট্রাক নিয়ে বাড়ি ফিরত্যাছিলাম। ওই সম (সময়) ঘটনা ঘটে।

ফারুখ হোসেন জানান, অবরোধকারীরা তার ট্রাক লক্ষ্য করে চারটি পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে। গাড়ির সামনের অংশে সেগুলো ফেটে আগুন ধরে যায়। ওই সময় তিনি দগ্ধ হন।

তানোর উপজেলা সদরের ব্র্যাক অফিসের সামনে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা হামলায় নারী ও শিশুসহ দগ্ধ হয়েছেন ৯ জন। এ ঘটনায় আহত জুলেখা (৩৫) গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে গার্মেন্টসে কাজ করেন। জুলেখার দুই হাত ও গোটামুখসহ শরীরের ৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।

জুলেখা বলেন, আমি পেশায় গার্মেন্টস শ্রমিক। কয়েক দিন থেকে কিছু খেতে পারছি না। দুই হাত তো ব্যাথায় নড়াতে পারছি না। সেই দিন থেকে বাম চোখে কিছু দেখতে পারছি না। আমি বাসের বনাটের পাশে বসেছিলাম কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি বাসে আগুন লেগে গেছে। আমার কাছে বসে থাকা আমার ছেলের মেয়ে ফারহানা তার কাপড়ে আগুন তখন আমি দুই হাত দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ততক্ষণে আমার হাতে আগুন লেগে যায়। কোন মতে টেনে হিচঁড়ে তাদের জ্বলন্ত বাস থেকে বের করেছি। জুলেখার নাতনি ফারহানা (৫) একই ঘটনার শিকার। তার শরীরের ৬ শতাংশ পুড়ে গেছে।

জুলেখা আর ফারহানা দেখা শোনার জন্য তাদের কাছে আছে জুলেখার ছোট ভাইয়ের বৌ। তিনি তাদের দুই জনকে দেখাশোনা করছেন।
খানপুর বাগবাজার গ্রামের আজিম উদ্দিনের মেয়ে আসিয়া এই ঘটনার শিকার। তাকে রাতেই রামেকে ভর্তি করা হয়। সকালে তার অবস্থার অবনতি হলে পরে তকে আইসিইউতে স্থানান্তর করেন চিকিৎসরা। তার শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে। পুঠিয়ার অজিদ কুমারের ছেলে তরুন বিশ্বাস (২৫)। তার শরীরের ১৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। চারঘাট সরদা এলাকার আব্দুল মজিদের ছেলে শিমুল (১৬)। তার শরীরের ৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। পিয়ারপুর গ্রামের হানু সরকারের ছেলে আশরাফ (৫০)। এর মধ্যে গত সোমবার আশঙ্কাজনক অবস্থায় নলছিটি ঝালকাঠি এলাকার সাইদুর রহমান ও মধুকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। এ দিকে গত ২১ জানুয়ারি মহানগরীতে রেশম ভবনের সামনে শিশির পরিবহন নামের যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় হরতাল ও অবরোধকারীরা। এ ঘটনায় আম্বিয়া বেগম (৫০) নামে এক নারী অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। তাকে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় অপর দুই আহত হলেন ঝালকাঠি এলাকার বারইকুড়াল এলাকার আবুল হাসানের ছেলে আবু সুফিয়ান (৫০) ও তার ছেলে মাইনুল (২০)। এর আগে গত ৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার আলিফ-লাম-মিম ভাটার মোড়ে পুলিশের ওপরে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় একজন এসআইসহ ৩জন পুলিশ সদস্য আহত হন। তার কয়েকদিন পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌর এলাকা ও কানসাট বাজারে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল সমাবেশ করার সময় পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে জমসেদ আলী (৪৫) নামে একব্যক্তি নিহত হয়। এ ঘটনায় আরও দুইজন গুলিবিদ্ধসহ ২০ জন আহত হয়েছে। একইদিনে পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরে পুলিশ-আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপি-জামায়াতের সংঘর্ষে মজির উদ্দিন (৪৫) নামের এক পথচারী নিহত হন। তিনি চারঘাট উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের স্কুলপাড়া খয়মুদ্দিনের ছেলে। এসময় আরও অন্তত ১০জন গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ৫০জন আহত হয়।

এ ঘটনার পর বানেশ্বরহাট, বেলপুকুর ও শিবপুরহাট এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এ আগের দিন গত সোমবার মহানগরীর মেহেরচ-ি এলাকা থেকে ১০টি পেট্রোল বোমা ও ২৪টি ককটেল উদ্ধার করেছে র‌্যাব। একই দিন কাটাখালীতে সমাবেশ চলাকালে রাজশাহী-৩ আসনের এমপি আয়েন উদ্দিন বক্তব্য রাখছিলেন। এসময় পাশ থেকে দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ঘটনাস্থল থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুই যুবককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।



মন্তব্য চালু নেই