মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে বরেন্দ্র অঞ্চল!

দেশের উত্তরজনপদের সবচেয়ে শুকনা ও উঁচু এলাকা হিসেবে চিহ্নিত রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল। গেল দুই দশক ধরে এ অঞ্চলের পানিস্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নামছে। পদ্মার তীরবর্তী এ অঞ্চলের আবহাওয়াও হয়ে পড়ছে দিন দিন চরমভাবাপন্ন। বর্ষাকালে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া আর সেই সঙ্গে ভূ-পৃষ্ঠের পানির ভাণ্ডার কমে আসায় দেশের খাদ্যভাণ্ডারখ্যাত উত্তরজনপদে সেচনির্ভর শস্য চাষ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

গত সাড়ে চার দশকে উত্তরাঞ্চলে লোকসংখ্যা দেড় কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার কোটিতে। এর সাথে প্রতিদিন যোগ হওয়া নতুন মুখের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। চাষ যোগ্য জমির প্রায় ৯৫ শতাংশই চলে এসেছে বোরো চাষের আওতায়। যার ৯০ শতাংশই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ভুগর্ভস্থ পানির উপর। বছর বছর পানি উত্তোলনের ফলে উত্তরের ভু-গর্ভ যেমন পানিশূন্য হয়ে পড়ছে তেমনি পাল্টে যাচ্ছে এখানকার পরিবেশও।

গ্রীষ্ম মৌসুমের তীব্র তাপদাহে উত্তরজনপদের কৃড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ কয়েকটি জেলায় ভোরে দেখা দিতে শুরু করেছে তীব্র কুয়াশা। দিনের বেলায় প্রচণ্ড গরমে গা জ্বালা করলেও রাত গভীর হতেই লাগছে শিরশিরে ঠাণ্ডা। চরমভাবাপন্ন এ আবহাওয়ার কারণেই উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু হয় কয়েক বছর আগে থেকেই।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিপ্তরের হিসাবে, ১৯৮৫ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৪৪ দশমিক ৬৭ ফুট গভীরে। ২০০০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৬২ ফুটে। মধ্যবরেন্দ্র অঞ্চলে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পানিস্তর ১৩ ফুট নিচে নেমে দাঁড়িয়েছে ৪০ ফুটে। নিম্নবরেন্দ্র অঞ্চলে এ স্তর নেমে যায় ৯ ফুট নিচে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালে মধ্যে পানিস্তর নেমে গেছে ১৯ ফুট। এ ছাড়া নওগাঁয় ২০ ফুট এবং নাটোরে ৩০ ফুটের বেশি।

সুত্রমতে, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে রাজশাহীর তানোর উপজেলায় পানিস্তর পরীক্ষা করতে গিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা ১৩০ ফুট নিচে শক্ত পাথরের স্তর দেখতে পেয়েছেন। যন্ত্রের সাহায্যেও এ স্তর ভাঙতে পারেননি তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভের পানিস্তর সাধারণত ১৩০ ফুটের মধ্যে অবস্থান করে। উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চলে ২০১০ সালে পানিস্তর নেমে যায় ১০৫ ফুটে। সে সময় মাত্র ২৫ ফুট নিচেই ছিল পানিশূন্য পাথরের শক্ত স্তর।

গেল ৬ বছরে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানিস্তর আশঙ্কাজনক হারে আরো নিচে নেমে গেছে। এ কারণে নিরাপদ পানির অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হয়ে উঠেছে গোটা বরেন্দ্র অঞ্চল। সম্প্রতি তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ইউনিয়নকে ওয়াটার স্টেজ এরিয়া (পানি সংকটপূর্ণ ইউনিয়ন) ঘোষণা হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইডাব্লুউআরএম) জরিপে ওই ইউনিয়নকে নিরাপদ পানির অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাঁধাইড় ইউনিয়নের সব গভীর নলকুপে থেকে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ করতে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানোর প্রস্ততি নিচ্ছে ডাসকো ফাউন্ডেশন। প্রস্তাবনা পেলে যে কোনো সময় ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করার ঘোষণা আসতে পারে সরকারের পক্ষে থেকে।

শুধু তাই নয়, ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তর দ্রুত নিচে নামায় বাঁধাইড় ইউনিয়নকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও সংকটপূর্ণ ইউনিয়ন হিসেবে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) তালিকায় প্রথম স্থানে অবস্থান করছে ওই ইউনিয়ন।

বিএমডিএর চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী সম্প্রতি জানান, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমে নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি মন্ত্রালয়ের নির্দেশ আছে যে, বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন করে আর গভীর নলকূপ স্থাপন করা যাবে না।

এর আগে ২০১৫ সালে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগতভাবে নিচে নামায় বরেন্দ্র অঞ্চলের ৩টি পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়ানকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় বিএমডিএর ৭০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। যা দীর্ঘ ২০ বছর দুই হাজার হেক্টর বেশি জমিতে সেচ সুবিধা দিয়ে আসছিল। এর মধ্যে ২০১৫ সালে থেকে বৌদ্দপুর মৌজার একটি গভীর নলকুপ পানির অভাবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আর কম পানি বা নাজুক অবস্থায় রয়েছে আরো ২৫টির বেশি গভীর নলকূপ।

বৌদ্দপুর গ্রামের গভীর নলকূপ অপরেটর আব্দুল আজিজ জানান, ২০১০ সাল থেকে তার গভীর নলকূপটি পানি কমতে থাকে। ২০১৫ সালে তা একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে পানির অভাবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তার এলাকায় ২০০ বিঘার বেশি জমি পতিত পড়ে আছে। বহরলই মৌজার গভীর নলকুপ অপরেটার নুরুজ্জামান জানান, তার গভীর নলকূপটি প্রথম অবস্থায় ২০০ বিঘার বেশি জমিতে চাষাবাদ করা হতো। বর্তমানে পানি কম উঠায় মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ বিঘা জমি চাষাবাদ হয়েছে। তিনি আরো জানান, পানি কম উঠায় এক বিঘা জমি ভেজাতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সেচ দিতে হচ্ছে। এই কারণে কৃষকেরা গভীর নলকূপের আওতায় জমিতে চাষাবাদ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এ গভীর নলকূপে এক বিঘা জমি চাষ করতে চার গুণ বেশি খরচ হচ্ছে।

বাঁধাইড় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, একযুগ আগেও ইউনিয়নে কুপ, টিউবওয়েল দিয়ে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় খাওয়ার পানি ব্যবহার করেছে সহজেই। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামায় বর্তমানে ইউনিয়ন এলাকায় কুপ ও টিউবওয়েল পানিশূন্য হয়ে পড়ে আছে। এখানকার মানুষের একমাত্র খাওয়ার পানি ভরসা গভীর নলকুপ ও সাব-মার্সেবল পাম্প। তাও বেশি পানি উঠেনা।

বিএমডিএ তানোর জোনের প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম বলেন, পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় ওই ইউনিয়নকে নিয়ে চিন্তিত বিএমডিএ। ধানের বদলে অন্য কোনো ফসল করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

আইডাব্লউআরএম’র রাজশাহী অঞ্চলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, বাঁধাইড় ইউনিয়নের পর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তরজনপদে দিন দিন নদ-নদীগুলো একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ বিভিন্ন নদী, উপ-নদী, শাখা প্রশাখা নদীতে এখন ছল ছল পানি প্রবাহের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে ধূ ধূ বালু চর। ভূ-তত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছর বছর ধরে উত্তরাঞ্চলে প্রয়োজনীয় বন্যা ও বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ভু-উপরিস্থ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে ভু-গর্ভের পানি ব্যবহার বেড়েছে। অতিরিক্ত পানি ব্যবহারের ফলে রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে।

এ নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে উত্তরাঞ্চলে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা কমছে না। দিন দিন বাড়ছেই। তবে চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ না পাওয়া আর ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ার জন্য সেচনির্ভর ফসল নিয়ে শঙ্কিত থাকতে হয় চাষীদের। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সহজ কোনো উপায় এখনও বের করা সম্ভব হয়নি। তবে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ)-এর বিশেষজ্ঞরা কয়েক বছর ধরে কম পানিতে উচ্চ ফলনশীল ধানের চারা উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি বোরো সেচের পানি অপচয় রোধে একটি বিশেষ কৌশল উদ্ভাবন করেছেন।

আরডিএ বগুড়ার কৃষি গবেষক একেএম জাকারিয়া বলেছেন, ভূ-গর্ভের রিজার্ভ ঠিক রেখে বোরো চাষ করতে কম পানি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে সেচের পানি অপচয় রোধ করতে যে কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে তা বরেন্দ্র অঞ্চলে সরকারি উদ্যোগে কাজে লাগানো হচ্ছে।



মন্তব্য চালু নেই