কলারোয়ায় মৌচাষের এক শিল্পিত রূপকার এবাদুল্যাহ আফজালের ইতিকথা ।। মধুতেই তাঁর মধুময় ভূবন
মৌমাছির মধু সংগ্রহের মতোই তিল তিল করে মধুচাষ শিল্পকে এগিয়ে নিয়েছে গ্রামীণ জনপদের হাতে গোনা কিছু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এক্ষেত্রে সম্প্রসারণের প্রক্রিয়াটি চলেছে চাষী থেকে চাষীতে। অনেক বেকার তরুণ নিজের অর্থ, উদ্ভাবণী চিন্তা ও আত্মবিশ্বাসকে বিনিয়োগ করেছে মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদন খাতে। এ ভাবেই মধু চাষে রীতিমতো বিপ¬ব ঘটিয়েছেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ব্রজবাকসা গ্রামের এক উদ্যমী যুবক এবাদুল¬াহ আফজাল (৩৫)। সারাদেশের মৌচাষীদের কাছে আজ আফজাল এক রোল মডেল নামে পরিচিত লাভ করেছে। নিজের মেধা, সৃষ্টিশীলতা ও নিবিড় পরিশ্রম তাকে এনে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতা। এবাদুল¬্যাহ আফজাল বাংলাদেশ মৌচাষী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া মৎস্য ও প্রণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত বাণিজ্যিক ভাবে মৌচাষের সম্ভাবনা বিষয়ক সরকারে করণীয় নির্ধারক কমিটির একজন সদস্য মনোনীত হয়েছেন এবাদুল¬্যাহ আফজাল। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে খলসি গ্রামে তার বাড়ী। এই গ্রামের কৃষক আমির হোসেনের ছেলে এবাদুল্য¬¬াহ আফজাল। লেখাপড়ায় তার সুযোগ মেলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত। দারিদ্রের কারণে তিনি ছেলেবেলা থেকেই নামেন জীবিকার সন্ধানে। তার চাচা আমির হামজা নিজের বাড়িতে দেশী মৌমাছির চাষ করতেন পূর্বে থেকে। চাচার এই মৌচাষই আগ্রহী করে তোলে আফজালকে। একদিন হুট করে তিনি নেমে পড়েন মৌচাষে। ২০০২ সালে তিনি সাতক্ষীরা কাস্টম্স অফিস থেকে সাড়ে ১৭ শ’ টাকা দিয়ে নিলামে ৪৬ টি স্কয়ার আকৃতির বাক্স কিনে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় একটি খামার গড়ে তোলেন। শুরুর পর ৪ বছরে তিনি অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন। বর্তমানে সাতক্ষীরা, সুন্দরবন, মানিকগঞ্জ, শরিয়তপুর, পাবনা, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি মৌ-খামার গেড়ে তোলেন। বাজারজাত ও বিপণের জন্য সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ব্রজবাকসা বাজারে তার ‘শিমু এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাজারে এই মধু ‘আফজাল মধু’ নামে পরিচিতি পেয়েছে সারা দেশে। এবাদুল¬্যাহ আফজাল এ প্রতিবেদককে জানান, মধু আহরণের ইতিহাস অনেক প্রাচীন থেকে। কিন্তু মৌচাষের শুরু এদেশে বেশি দিনের নয়। সত্তর দশকে বিসিকের সহায়তায় প্রযুক্তিগতভাবে দেশীয় (এপিস সেরেনা) মৌচাষের সূচনা ঘটায়। বর্তমানে আমার মতো কয়েক হাজার মৌচাষী বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন কাজে নিয়োজিত রয়েছে। আবার পারিবারিক ভাবেই এদেশে মধু উৎপাদন করেন অনেকেই। যা থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর মধু উৎপাদন হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার মেট্রিক টন। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে মৌমাছির অবদানের কথা আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষক অবগত নন। যে কারণে মৌচাষ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অনেক সময়। এবাদুল্যাহ আফজাল একুশে নিউজের সাংবাদিক জুলফিকার আলীকে জানান, পরাগায়নের ক্ষেত্রে মৌমাছি প্রধান সহায়ক। সঠিক পরাগায়ন না হলে কাঙ্খিত ফলন হবে না। দেখা দেবে খাদ্য ঘাটতি। উন্নত দেশগুলোতে মধু চাষের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশে মৌচাষীদের সংগঠিত করে ‘মৌচাষী কল্যাণ সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেছি। ২০১১ সালের ১২ জানুয়ারী আমরা সমিতির নিবন্ধন করি। মৌচাষীদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, মধু বাণিজ্যিক ভাবে বাজারজাত করনের জন্য আমি ইতো মধ্যে ঢাকার এপি মধু কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি আরও অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্য। এছাড়া তিনি বিদেশেও মধুর নমুনা পাঠিয়েছেন। বিদেশীরা মধূর মানে সন্তুষ্ট হলে তিনি মধু রপ্তানি করতে পারবেন। গত ২০১১সালের ১৫ মে ঢাকায় জাতীয় মৌচাষী সম্মেলন হয়েছিলো। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ ফারুক খান ছিলেন। ওই সম্মেলনে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন মৌচাষীরা। বক্তব্যে মৌচাষী আফজাল বলেন, দেশের মধুর বাজার নিশ্চিত করতে বিদেশী মধুর আমদানি বন্ধ করা দরকার। মৌমাছি প্রতিপালনের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির দেশী ও বিদেশী সংগঠনের সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন। এদের মধ্যে রয়েছে: বিসিক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও প্রাণী বিজ্ঞানী এবং কানাডার পুষ্টি বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. আব্দি সাফারি। ড. আব্দি সাফারির মতে, মৌমাছির প্রধান কাজ মধু উৎপাদন। একটি রাণী মৌমাছিকে ঘিরে হাজার হাজার মেয়ে মৌমাছি মধু উৎপাদন করে যাচ্ছে। রাণীর কাজ শুধু ডিম পাড়া। মৌমাছি ফুল থেকে নেকটার সংগ্রহ করে মুখের লালা ও অন্যান্য এনজাইম দিয়ে মধু তৈরি করে। পর্যায়ক্রমে হাজার হাজার মৌমাছি তাদের পাখা দিয়ে বাতাস করে মধু থেকে আর্দ্রতা দূর করে। পরবর্তীতে ওইগুলোকে প্রকোষ্ঠে, মোমের আবরণে সংরক্ষণ করে। যখন একটি কলোনির সবগুলো প্রকোষ্ঠকে মোমের আবরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়, তখন ওই মধুকে আমরা খাঁটি মধু বলতে পারি। প্রাকৃতিক মধুর অনেক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে। মৌচাষী সম্মেলনে ড. সাফারি বলেন, অনেকে কাঁচা মধু তাপ দিয়ে ঘনত্ব বাড়িয়ে থাকে। কিন্তু এতে মধুর ঔষধি গুণাবলি নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব দেশেই তাপ দিয়ে মধু প্রক্রিয়াজাত করার কাজ বন্ধ। কানাডা, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া ও ইউরোপে এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। সফল মৌচাষী আফজাল মৌমাছির জাত ও মধু উৎপাদনের সময় প্রস্েঙ্গ জানান, আমরা দু’ধরণের মৌচাষ করে থাকি। এপিস সেরেনা মৌচাষ-দেশীয় মৌমাছি দ্বারা পরিচালিত এবং এ চাষ ব্যক্তি কেন্দ্রিক ৫/১০ টি মৌ কলোনী নিয়ে গঠিত। আর এপিস মেলিফেরা মৌমাছি চাষের মাধ্যমে ৫ শ’ পর্যন্ত মৌ কলোনী নিয়ে মৌখামার প্রতিষ্ঠা করে বাণিজ্যিক ভাবে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪ ধরণের মৌমাছি রয়েছে: এপিস ডরসেটা, এপিস সেরেনা, এপিস ফ্লোরিয়া ও এপিস মেলিফেরা। এপিস মেলিফেরা চাষের মধ্য দিয়ে আফজাল তার মৌচাষ জীবনের শুরু করেন ও সফলতা পান। মৌমাছির মধ্যে এপিস ডরসেটা ও এপিস ফ্লোরিয়া মৌমাছি এদের স্বভাবগত কারণে চাষ করা সহজতর নয়। এবাদুল¬্যাহ আফজাল আরো বলেন, এপিস সেরেনা আমাদের দেশীয় প্রজাতির হলেও এদের মধু উৎপাদন ক্ষমতা খুব কম। মৌমাছি আকারে ছোট এবং এদের মাধ্যমে বাণিজ্যিক খামার প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। তবে এ প্রজাতির মাধ্যমে মহিলা বা স্কুল পড়–য়ারা অবসরে মৌচাষ করে পরিবারে বাড়তি আয়ের যোগান দিতে পারে। এপিস মেলিফেরা প্রজাতির মৌমাছি পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশের। এ প্রজাতির মাধ্যমে বড় খামার প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। কারণ এদের মধু উৎপাদন ক্ষমতা বেশি। আমাদের দেশে রবিশস্য, গাছপালা ও ফুল-ফলে মৌচাষ করা হয়। কিন্তু মধু উৎপাদনের সময়কাল হিসেবে নভেম্বর-জানুয়ারী (সরিষা ফুলের মধু), ফেব্র“য়ারী (রাইসরিষা, কলাই, ধনিয়া, কালজিরা), মার্চ (লিচু), এপ্রিল-মে (খলিসা, গড়ান, কেওড়া, বাইন ফুল বা সুন্দরবনের ফুলের মধু) উৎপাদন করা হয়। অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মে-এই ৭ মাসকে মোটামুটি মৌচাষের মাধ্যমে মধু উৎপাদনের আদর্শ সময় ধরা হয়। তবে কোন কোন সময় সেপ্টেম্বর মাসে বড়ই ফুল থেকে মধু পাওয়া যায়। আফজাল বলেন, মধু একটি অপচনশীল পদার্থ। খাঁটি মধূ এমন একটি উপাদান যেখানে কোন প্রকার বিষজাতীয় বা বিরক্তিকর কোন গন্ধ থাকে না। এবাদুল¬্যাহ আফজাল আজ পরিপূর্ণ এক সফল ও স্বাবলম্বী মৌচাষী। তিনি নিজে মৌচাষ করে ভাগ্য বদলিয়েছেন। অপারদেরকেও ভাগ্য বদলেও সহায়তা করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তার মৌখামারের সংখ্যা ৬টি। মৌচাষী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আফজাল তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। মৌচাষের উন্নয়নে গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, বেকার যুবসমাজকে এ চাষের আওতায় আনা, প্রান্তিক কৃষকদের মৌমাছির পরাগায়নের সুফলতা সম্বন্ধে ধারণা দেওয়া, মধুর বহুবিধ ব্যবহারের প্রচারণা, উন্নত প্রজাতির মৌমাছি আমদানি ও মধু রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করা, মধু চাষকে পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভূক্তকরণ, মৌচাষীদের কৃষি ভর্তুকির আওতায় আনা-ইত্যাদি অনেক পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা করেন।
মন্তব্য চালু নেই