মুস্তাফিজ বললেন, তিনি আগের মতোই আছেন
সেই একই দৃশ্য। উঠানময় মানুষ। বাড়িতে পা রাখার পর থেকেই সবার মনোযোগের কেন্দ্রে মুস্তাফিজ। সবাই একনজর দেখতে চায় ঘরের ছেলেকে। ছুঁয়ে দেখতে চায় তাঁর সেই হাত। যে হাত দিয়ে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের ‘বধ’ করার সেই অস্ত্র ‘কাটার’ বেরিয়ে আসে একের পর এক। শুনতে চায় তাঁর রূপকথার নায়ক হয়ে ওঠার গল্প। সবার আবদার মেটাতে গিয়ে একটু যেন ক্লান্তও তিনি।
ব্যস্ত ক্রিকেট-সূচির পর আরাধ্য বিশ্রাম মিলেছে ক্রিকেটারদের। কিন্তু মুস্তাফিজের বিশ্রাম নেওয়ার সময় কোথায়? সকালে ঘুম থেকেও উঠতে হয়েছে আগেভাগেই। বিশ্রাম তো আগেই উঠেছে শিকেয়। কিন্তু এত কিছুর পরও মুস্তাফিজের মুখে লেগে আছে সেই চিরচেনা হাসি। মানুষের ভালোবাসা বলে কথা। ভালোবাসার হাতছানি উপেক্ষা করা এত সোজা নয়।
বাড়ির আঙিনায় মানুষের জটলা। সেখান থেকে একটু কৌশলে পালিয়েই বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন তিনি। বিছানায় এলিয়ে দিলেন শরীরটা। ক্লান্তিভরা মুখে বললেন, ‘কী করব বলেন! শ্যামনগর থেকে এক ক্যানসার রোগী ভ্যানে শুয়ে এসেছেন আমাকে দেখতে। হাঁটার শক্তি নেই দেখে বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারেননি। রাস্তায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছি। নোয়াখালী থেকে এসেছে এক ছেলে। সে আবার ক্রিকেটার হতে চায়। টিপস জেনে নিল আমার কাছ থেকে। এমনি কত যে মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে!’
আগের দিনই জানিয়ে রেখেছিলেন, ঘুরিয়ে দেখাবেন সেই তেঁতুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ, যেখানে তাঁর ভিত্তি। যেখানে খেলেই উঠে এসেছেন তিনি। বড় ভাই মাহফুজুর রহমান, মেজো ভাই জাকির হোসেন আর সেজো ভাই মোখলেসুর রহমানকে নিয়ে পড়লেন খররোদেই।
নতুন কেনা বাইকের পেছনে বসালেন মোখলেসুর রহমানকে। একটা সময় ছবিটা ছিল ঠিক উল্টো। তেঁতুলিয়া থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সাতক্ষীরায় মুস্তাফিজকে এভাবে মোটরবাইকের পেছনে বসিয়ে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন মোখলেস। দিন বদলেছে, বদলেছে ছবিও। এখন নিজের বাইকে সেজো ভাইকে বসিয়ে এগিয়ে চলেন সামনে। এই দিনটির জন্যই হয়তো তাঁর এত দিনের পরিশ্রম।
প্রথমেই গেলেন মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, যে স্কুলে পড়েছেন ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। মুস্তাফিজকে পেয়ে হঠাৎই যেন প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল গোটা এলাকা। মুঠোফোন হাতে না থাকায় ছবি তোলাটা হয়তো হলো না কিন্তু হিড়িক পড়ে গেল সই-সংগ্রহের। মুস্তাফিজও হাসি মুখে অকাতরে বিলালেন অজস্র সই। স্কুলের ভেতরেই পাওয়া গেল দুর্লভ এক ছবির সন্ধান। বছর পাঁচেক আগে স্কুল দলের হয়ে খেলার সময় তোলা। তবে ক্রিকেট নয়; মুস্তাফিজের ওই ছবিটি স্কুলের ফুটবল দলের সঙ্গে তোলা। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলটাও ভালোই খেলতেন তিনি।
বিটিজিআর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও তেঁতুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এখনো রয়েছে মুস্তাফিজের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার দিনগুলোর স্মৃতি। শুরুর দিনগুলোয় এখানেই খেলেছেন ফাইভস্টার বলে। তেঁতুলিয়া মাঠের এক প্রান্তে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা মেহগনিগাছগুলো দেখালেন একসময়ের সতীর্থ মিজানুর রহমান। যেখানে সুতো দিয়ে নেট বানিয়ে করতেন অনুশীলন। সুতো বাঁধার পেরেকের দু-একটা এখনো লেগে আছে গাছের শরীরে। মিজান জানালেন, ‘ফাইভস্টার বলেও বেশ সুইং করাতে পারত। আর গতি তো ছিলই।’
রসিকতা করে মিজানকে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে বসলেন মুস্তাফিজ! অনুশীলন করার জায়গাটাতে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন মিজান আর ফাইভস্টার বল হাতে মুস্তাফিজ। মুহূর্তের জন্য অতীতকে মূর্ত করে তোলার আবেগময় এক প্রয়াস। প্রথম বল ওয়াইড। ‘কিরে ভয় পেলি নাকি?’ টিপ্পনী কাটলেন মিজান! মুখে সরল হাসিটা থাকলেও ভেতরে যেন জেগে উঠল ক্রিকেটীয়-বোধ। এবার ঠিক জায়গায় বল ফেলে পরাস্ত করলেন ব্যাটসম্যানকে। ভাগ্যিস স্টাম্প ছিল না। চট্টগ্রাম টেস্টে কুইন্টন ডি ককের স্টাম্প যেভাবে ডিগবাজি খেয়েছিল আজ হয়তো তেঁতুলিয়া মাঠে তেমন কিছুই দেখতে হতো সবাইকে!
সেজো ভাই মোখলেস হাত ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখালেন। বললেন, ‘মাঠের অবস্থানটা খেয়াল করেছেন? দুপাশে দুটো স্কুল। এক পাশে বাজার, আরেক পাশে মন্দির। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থাপনার একদম মাঝখানে মাঠটা। যখন টুর্নামেন্ট বা অন্যান্য খেলার আয়োজন করা হয়, মাঠের চারপাশে তখন কয়েক হাজার মানুষ জমে যায়। ও ছোটবেলা থেকেই হাজার হাজার মানুষের সামনে খেলে অভ্যস্ত। এ কারণে স্টেডিয়াম-গ্যালারির হাজারো মানুষের সামনে খেলতে মোটেও স্নায়ুচাপ কাজ করে না তার মধ্যে। যেকোনো জায়গায় স্বচ্ছন্দেই নিজের খেলাটা খেলতে পারে মুস্তাফিজ।’
তেঁতুলিয়া মাঠে খেলতে খেলতেই একপর্যায়ে সুযোগ পেলেন সাতক্ষীরা জেলার অনূর্ধ্ব-১৬ দলে। এরপর খুলনা বিভাগের অনূর্ধ্ব-১৮, জাতীয় অনূর্ধ্ব ১৯, তারপর বাংলাদেশ ‘এ’ দলে। বয়সভিত্তিক দলগুলোর সিঁড়ি ভেঙে অবশেষে জাতীয় দলে। বাকিটা তো জানাই। বাংলাদেশ দলের হয়ে একের পর এক কীর্তি। ক্রিকেট-বিশ্বে ‘বিস্ময়’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া।
উপস্থিত জনতার অনুরোধে তপ্ত দুপুরে যেতে হলো মাঠের মূল পিচে। আবারও হাতে তুলে নিলেন বল। কেউ একজন পাশ থেকে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, ‘ওর খেলার ধরন আর আগের মতো নেই! কত বদলে গেছে!’
বদলাবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে ব্যক্তি মুস্তাফিজ আগের মতোই আছেন। বললেন, ‘আমি খুবই সাধারণ। কোনো তারকা-টারকা নই। আমি ভাই আগের মতোই আছি।’প্রথম আলো
মন্তব্য চালু নেই