শচীন দেবের বাড়ি এখন মুরগির খামার

বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা- মীরা দেব বর্মণের লেখা গানটি শচীন দেব বর্মণের গলায় শোনেননি এমন বাঙালি খুব কমই আছেন। বাংলা গানের দিকপাল শচীন দেব বর্মণের পৈতৃক ভিটে বা শৈশবের স্মৃতিময় বাড়িটি কুমিল্লা শহরে অবস্থিত। এখন এটি একেবারেই অযত্নে-অবহেলায় সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকায় শচীন দেব বর্মণের স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনটি অবস্থিত। কিন্তু সেখানে তাঁর সেই বাসভবনের কোনো চিহ্ন আর নেই। আছে একটি মুরগির খামার। নতুন প্রজন্ম জায়গাটিকে চেনে সরকারি মুরগির খামার হিসেবে। এটাকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর গ্রহণ না করায় বাড়িটি আর দশটি রাজবাড়ির মতোই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় দিন দিন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যাচ্ছে।

১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকায় রাজবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন শচীন দেব বর্মণ। বাড়ির বাইরের দেওয়ালে একটি শ্বেতপাথরের খোদাই করা স্মৃতিফলকে লেখা রয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শচীন দেবের এই বাড়িতে একবার অতিথি হয়ে এসেছিলেন। সব কিছু মিলিয়ে এ বাড়িটি বাংলা গানের ইতিহাসের একটি মাইলফলক।

কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকার গোলপুকুরের দক্ষিণ পাড়ে এই বাড়িটি ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের ভাই মহারাজ নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মণ বাহাদুরের। ত্রিপুরার এই মহারাজার স্ত্রী ছিলেন বেশ কয়েকজন। বাড়িটা ব্রিটিশ আমলের জমিদার বাড়ির আদলে তৈরি । এর গঠনশৈলী রাজপ্রাসাদের মতো না হলেও এটাই মহারাজ নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মন বাহাদুরের বাড়ি।

কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরার রাজা-মহারাজাদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনকেন্দ্র। সে কারণেই এ শহরে রানীর কুঠি, রানীর দীঘি, রাজবাড়ি গড়ে ওঠে। কিন্তু অবহেলা–অনাদরে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছে সেসব স্বাক্ষর।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কালের সাক্ষী এই বাসভবনটি প্রথমে সামরিক গুদাম হিসেবে ব্যবহত হয়। তারপর ১৯৫৮ সালে পশু চিকিৎসার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই থেকেই ভবনটির চারদিকে প্রায় চার একর জমির উপর এখন সরকারি মুরগির খামার। ভবনটি কখনো খামারের হাঁস-মুরগি পালনের কাজে ব্যবহৃত না হলেও খামার প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে ভবনটি প্রথমে অফিস ও পরে খামারের পরিচালককের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন সেটি বসবাসের অনুপযোগী । দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে বাড়িটির ভেতর-বাহির । খসে পড়ছে চুন-সুড়কির পলেস্তারা। খামগুলে ক্ষয়ে যাচ্ছে। ছাদ চুয়ে পানি পড়ে। যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা ।বর্তমানে ভবনটির সামনে-পেছনে খামারের নুতন ভবন তৈরি হওয়ায় বাড়িটি আড়ালে পড়ে গেছে।

এই ভবনটির দখলস্বত্ব খামার কর্তৃপক্ষ নেওয়ার পর ১৯৮৫-৮৬ সালে ভবনটিতে সামান্য সংস্কার করা হয়েছিল। তারপর থেকে এদিকে আর কেউ ফিরে তাকায়নি। চারদিক থেকেই ঘেরাও হয়ে থাকার কারণে বাইরে থেকে ভবনটিকে আর দেখা যায় না।

এই বাড়িটি এখন সরকারের পশু দপ্তরের কাছ থেকে দখলমুক্ত করে, সেখানে সংস্কৃতি কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য এলাকার সংস্কৃতিসেবীরা বহুদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের প্রত্যাশা, এটি দ্রুত দখলমুক্ত করে সংস্কার করা হলে দুই বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্প ও সঙ্গীতপ্রিয় বাঙালির কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ।



মন্তব্য চালু নেই