বালিয়াকান্দিতে রামায়ন-মহাভারত অবলম্বনে ১৫১টি প্রতিমার দুর্গা পুজা

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দিতে ১৪১ টি মন্ডপে সার্বজনীন শারদীয় দূর্গোৎসব ব্যাপক আয়োজন ও অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি দ্রুত গতিতে চলছে। প্রতিমায় প্রলেপ সহ শেষ মুহৃর্তের সব আয়োজন ব্যস্ততার সাথে করে চলছেন প্রতিমা শিল্পীরা।

দূর্গা দুর্গতিনাশিনী- দশভূজা দেবী দুর্গা আমাদের মাঝে আসছেন । তাই প্রতিমা শিল্পীরা দেবী দুর্গা, স্বরসতী, লক্ষ্মী, কার্তিক ও গনেশসহ নানা দেব-দেবীর প্রতিমার রূপকে ফুঁটিয়ে তুলছেন নিপুন হাতের ছোঁয়ায়। পূজা মন্ডপে আঁকা হচ্ছে রকমারি আল্পনা। সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বী সব মানুষের মনে খুঁশির আনন্দে দোল দিচ্ছে ।

মন্ডপে মন্ডপে মাটি আর খড়ে গন্ধ মিলেমিশে একাকার। কোথাও দেবীর হাতের আঙ্গুল বানানো হচ্ছে। কোথাও আবার পরম যতে শিল্পী তৈরী করছেন দেবীর মুখের ছাঁচ। নিরাভরণ দূর্গা প্রতিমা দিকে দৃষ্টি ফেললে শিল্পীর হাতের যাদুতে এখনই মনে হচ্ছে মহালয়ার আগেই প্রান পেয়েছে দেবী দূর্গা। পুজার কেনাকাটাও চলছে পুরোদমে। গ্রামে থেকে শুরু করে শহরের দোকান ও বিপণী বিতান গুলোতেও হিন্দু সমপ্রদায়ের নর-নারী ও শিশু কিশোরদের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এবারের পুজা উপলক্ষ্যে বেচাকেনা ভাল হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও খুশি। দূর্গা পূজা আগে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ঋতুতে হতো। ভারত ও বাংলাদেশে শরৎ ও বসন্ত- দুই ঋতুতে এই পূজা হতো। তবে বাংলা এবং আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ধুমধামের সাথে শরৎ কালেই এই পূজা করা হয়। যে কারণে এই পূজার আর এক নাম শারদীয়া দুর্গোৎসব।

এবার ভক্তের আকাঙ্খা পুর্ণ করতে মা দূর্গা আসবেন শরতে, তাই ঢাকের বাজনা, উলুধ্বনি ও আরতীতে মুখরিত হবে শহর, পাড়া মহল্লা ও গ্রাম। দর্শনার্থীদের আনন্দ ও নিরাপত্তা দিতে গ্রাম শহরের সড়ক গুলোতে চলছে বিভিন্ন প্রস্তুতি যেমন- অলোক সজ্জা, তোরণ ও মন্ডপ আকর্ষণীয় করতে রঙ্গিন বাতি। পুজা মন্ডপের সামনে তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টি নন্দন তোরণ।

এ বছরও আয়োজনের কমতি নেই রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের নলিয়া জামালপুর- আলোকদিয়া গ্রামে সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরে । পুকুরের উপর ৫০ ফুট উচুতে পাহাড়ের উপর ৬ষ্ট তলা ভবন নির্মান করে রামায়ন-মহাভারত ও বৈদিক কাহিনী অবলম্বনে ১৫১ টি বিভিন্ন দেব দেবীর প্রতিমা উপস্থাপন করে সবচেয়ে ব্যয় বহুল জাকজমক পুজা উপহার দিতে চলছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। এ মন্দিরে প্রতি বছরেই বাড়তি ভক্তের মনোরঞ্জনে ব্যতিক্রমধর্মী সাজ সজ্জায় বাড়তি আকর্ষণ থাকে। যা গোবিন্দ বিশ্বাসের নির্দেশনায় হয়ে থাকে।

প্রতিমা শিল্পী ফরিদপুরের বিলাশ পাল জানালেন, গত ৩ মাস পূর্ব থেকেই তিনি ঠাকুর গড়ার কাজ করে চলছেন। আমার সঙ্গে ১০ জন সহ- শিল্পী কাজ করে আসছেন। ১৫১টি প্রতিমার মধ্যে লক্ষণ, শক্তি সেন, অশোক বনের সিতা, লকপুশ কর্তৃক মজ্ঞের ঘোড়া বন্ধন, পিতা-পুত্রের যুদ্ধ, লক পুষ কর্তৃক হুনুমানের বন্ধন, বাল্মিকীমনির রাম লক্ষন অনান্যেদের জীবন দান, কালীর দশ রুপ, দুর্গার ৯ রুপ, করুক্ষেত্রের যুদ্ধ, ধ্রুবদির বস্ত্রহরন, দুর্যধন ভিম দাযুদ্ধ, চার যুগের যুগ অবতর, মহাসমুদ্রে নারায়ন, দেবাদিদেব মহাদেবসহ ১৫১টি প্রতিমার পুজা ইত্যাদি। রামায়ন-মহাভারত ও বৈদিক কাহিনী অবলম্বনে এ সব দেব- দেবী গুলো সার্বজনীন দূর্গা মন্দির সংলগ্ন জলাশয়ে ৫০ ফুট দীর্ঘ ৬ষ্ট তলা বিশিষ্ট পাহাড়ের উপর নির্মিত প্লাট ফর্মে স্থান পাবে।

এ প্লাটফর্ম থেকে প্রায় ৪০ ফুট উপরে পর্বত শৃঙ্গে থাকবেন মহাদেব। তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড। জলাশয়ের বিভিন্ন স্তারে জীব শিক্ষার প্রয়োজনীয় কথোপকথন ও নির্দেশনা। পানির উপর ভাসবে ভাষ্কর ইন্দ্রজিত দত্তর তৈরী বাংলাদেশে এই প্রথম শোলা দিয়ে তৈরী মহাসমুদ্রে নারায়ন। যা অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ তা দেখেই নিজে ও পরিবারের জ্ঞানচক্ষু খুলতে পারবে। যা বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ। জলাশয়ে থাকবে কুমির ও হাতির সুর থেকে বের হবে পানির ফোয়ারা।

যা আলোক সজ্জায় ভক্তকে মুগ্ধ করবে। বাইরে থেকে জলাশয়ে নির্মিত মন্দিরটি দেখলে মনে হবে কোন সুরঙ্গ। এ ৬ষ্ট তলা মঞ্চটি তৈরী করতে ২ হাজার বাশ, ৪০ মন লোহা, কাঠ ও কারিগর জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাসসহ ১০জন ৩মাস আগে থেকে কাজ করছেন।

গৃহবধু পুষ্পরাণী বিশ্বাস জানান, প্রতিবছর আমরা এই দিনটির জন্য সবাই অপেক্ষা করে থাকি। আমাদের গ্রামের বধুদের পিতা বাড়ী যাওয়া তো দূরের কথা, বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ভক্তবৃন্দ ও স্বজনদের সেবা করতে করতে কিভাবে যে মা দূর্গা বিদায় নেন তা টের পাই না। তবে দূর্গা পুজার মূল কাহিনী জানতে চাইলে তিনি জানান, অসুরদের অত্যাচারে পৃথিবী যখন অতিষ্ট, দেবতারা যখন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত, তখন অসহায় দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের স্মরণাপন্ন হন।

ব্রক্ষ্মার অমরত্ব লাভ করে মহিষাসুর ঈশ্বরের মত একক ক্ষমতা লাভ করতে চেয়েছিল। তাই তাকে কোন পুরুষের পক্ষে ধ্বংস করা সম্ভব ছিল না। তাই মহিষাসুরকে বধ করতেই নারীরূপে দূর্গার আবির্ভাব হয়। ঐ ত্রিশক্তি সম্মিলিত তেজে নারী রূপে দেবী দূর্গা শক্তির উৎভব হয়। দেবী দূর্গা আবার একাকী নন। তিনি অন্যান্যদের নিয়ে যেমন ধন (লক্ষী), শিক্ষা (স্বরস্বতী), কার্তিক (যোদ্ধা), গনেশ (সিদ্ধিদাতা), সকলকে নিয়ে মহিষাসুর বধে ব্রতী হন। সে যাত্রায় অসুররা সমূলে ধ্বংস হয়।

এ পুজার প্রধান পৃষ্টপোষক ও আয়োজক গোবিন্দ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, পৃথিবীতে এখনো নানা অত্যাচার শোষন নিপিড়ন রয়েছে। যে কাজগুলো সে যুগে অসুররা করতো। তাই আজও অন্যায়র বিরুদ্ধে দেবী দূর্গার পুজা অর্থবহ। শরৎকালে অসুর বধে মা দূর্গা সেদিন যে ভূমিকা রেখেছিলেন, আজও তা অন্যায় বন্ধ করতে প্রয়োজন। এই শিক্ষাই দেবী দূর্গার পুজার শিক্ষা। ঐক্যবদ্ধ সম্মিলিত চেষ্টাই হচ্ছে এই পুজার অনন্য সারমর্ম। তাই এটি সার্বজনীন পুজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চন্ডিপাঠ করে এই পুজা বা আরাধনা করে থাকেন। ধর্মমতে এ সময় দেবদেবীরাও দূর্গাপুজার জন্য প্রস্তুত হন, তারাও মা দূর্গার আরাধনা করেন। এ সময় পৃথিবীর মানুষ নদীতীরে পূর্ব পুরুষদের জন্য শন্তি কামানা করে থাকে।

মন্দির কমিটির সভাপতি বিধান চন্দ্র ভট্রাচার্য্য জানান, উপমহাদেশের মধ্যে ব্যায় বহুল ও দৃষ্টি নন্দন পুজার আয়োজন করতে পেরে তখনই ধন্য হবো , যখন পুজারীদের মনের বাসনা পুর্ন হবে। তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

উপজেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অবঃ অধ্যক্ষ বাবু বিনয় কুমার চক্রবর্ত্তী জানান, প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও জামালপুরের গোবিন্দ বিশ্বাস সর্ববৃহৎ পুজার আয়োজন করেছেন। যা উপভোগ করতে দেশ বিদেশের পুজারীরা এখানে ছুটে আসবেন।

বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল হাসান জানান, পুজা উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ নজরদারীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষনিক থাকবেন।



মন্তব্য চালু নেই