গণতন্ত্র হঠাৎ পেয়ে যাওয়া কোনো বিষয় নয়

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সরকারের ৪ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ১৯ জানুয়ারি। ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়নে নির্বাচনে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। মুলত ট্রাম্পের অভিষেক ভাষণের মধ্য দিয়ে ঘটে যাবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মেয়াদের সমাপ্তি।

এটি প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার টানা দ্বিতীয় মেয়াদ। ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রথম মেয়াদে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু দায়িত্ব পালনকালে তার পথটা মসৃণ হয়নি। কিছু সংস্কার পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন কিন্তু রক্ষণশীলদের প্রচণ্ড বিরোধিতার কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বারাক ওমাবা প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পুনরায় জয়লাভ করেন এবং ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এদিন তিনি শিকাগোর লেকসাইড কনভেনশন সেন্টারের পাশে ম্যাককমিক প্লেসে দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও আমন্ত্রিত অতিথিদের সমাবেশে অভিষেক ভাষণ দেন। তার এই ভাষণ সে সময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

দেশটিতে সংবিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না। সে কারণে আবারো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ছিলো না। তাই বিদায় তাকে নিতেই হচ্ছে। গত ১০ জানুয়ারি তিনি বিদায় ভাষণ দেন। শিকাগোর লেকসাইড কনভেনশন সেন্টারের পাশে ম্যাককমিক প্লেসে সমবেত সুধীমণ্ডলীর সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে এই ভাষণ দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটাই তার শেষ ভাষণ।

প্রেসিডেন্ট ওবামার বিদায়ী ভাষণ শোনার জন্য রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। নাগরিকরা টেলিভিশনের সামনে ভিড় করেন। ওবামা প্রায় ৪০ মিনিট বক্তব্য রাখেন। তিনি দুই মেয়াদে নিজের আট বছরের শাসনকালে সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। এসবের মধ্যে রয়েছে মন্দা মোকাবিলা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ। তার সরকার এই ক্ষেত্রগুলোতে সাফল্য পেয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অবশ্য তার ভাষণে প্রকাশ পেয়েছে দেশের ভবিষ্যত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। তিনি বলেছেন, আমাদের চারপাশে কোনো না কোনোভাবে বৈষম্য আছে। তা হতে পারে স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় উপাসনালয় কিংবা কর্মস্থলে। বর্ণবৈষম্য এখনও আছে। এগুলোকে পরাস্ত করতে হবে মানবতার আলোকে। রাজনীতিতে দলপ্রীতি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।

নাগরিকদেরকে গণতন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র হঠাৎ পেয়ে যাওয়া কোনো বিষয় নয়।’ গণতান্ত্রিক আদর্শ চর্চা করার এবং তা বজায় রাখার জন্য ক্রমাগত লড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই লড়াইয়ে কখনো জয় আছে, কখনো পরাজয় আছে।’ তিনি সব পরিস্থিতিতে নাগরিকদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখার আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের উন্নতির জন্য ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে কোনো মূল্যে গণতন্ত্র রক্ষা করতে হবে, ভয়ের কাছে পরাস্ত হলে গণতন্ত্র হোঁচট খাবে।’

ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। নিজের স্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার প্রশংসা করে বলেন, মিশেল কেবল তার স্ত্রীই নন, একজন ভালো বন্ধু। ওমাবার চোখে জল নেমে আসে এবং সেই আবেগ অন্যদের স্পর্শ করে যায়।

অতীতের অনেক রাজনৈতিক নেতা ও রাষ্ট্রনায়কের বক্তব্য পৃথিবীতে অমর হয়ে আছে। বারাক ওবামাসহ যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে অনেকেই তাদের মূল্যবান বক্তব্যের জন্য নন্দিত। এদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুতে আছেন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। ৪৪ তম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার বিদায়ী ভাষণে একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন তা হলো গণতন্ত্র। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র হঠাৎ পেয়ে যাওয়া কোন বিষয় নয়।

বারাক ওবামার এই কথার যে অর্থ, তা নতুন কিছু নয়। তবুও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিদায়ী ভাষণে এর উল্লেখ অনেক গুরুত্ব বহন করে। গণতন্ত্রের চর্চা করতে হয় প্রজন্ম পরম্পরায় এবং তা ধরে রাখার জন্য অনুশীলন করতে হয়। আর এর মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক আদর্শ পরিশীলিত হয়ে ওঠে। জাতি হয় সমৃদ্ধ, রাষ্ট্র হয়ে ওঠে উন্নত। নাগরিক অধিকার সমুন্নত হয়।

সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাফল্য ব্যর্থতার মূল্যায়ন করবেন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। আর রাজনীতির ইতিহাসে তিনি কোথায় স্থান পাবেন তা নির্ধারণ করবে ইতিহাস।

ওবামার ভাষণে আরও একটি বিষয় সু্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, তা হলো পরিবারের প্রতি আন্তরিকতা। যুক্তরাষ্ট্রের আর কোন প্রেসিডেন্টের আনুষ্ঠানিক বিদায় ভাষণে নিজের স্ত্রী ও ফার্স্ট লেডির প্রশংসা করার নজির পাওয়া যায় না। বারাক ওবামা রাষ্ট্রীয় ভাষণে মিশেল ওবামার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সম্ভবত নতুন ইতিহাস গড়েছেন।

লেখক: সাংবাদিক।

তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান, দি ইনডিপেনডেন্ট, বিবিসি।



মন্তব্য চালু নেই