সিরীয়দের খাবার যোগাচ্ছে যে বেকারি

গত পাঁচ বছরে নাটকীয়ভাবে অবস্থা পাল্টে গেছে রেহানলি শহরের। সিরিয়ায় যুদ্ধ বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তবর্তী এই শহরটিরও কদর নীরবে বাড়তে থাকে। আলেপ্পো এবং ইদলিব থেকে শরণার্থীদের প্রবেশের অন্যতম রাস্তা হিসেবে এই ছোটো শহরটিকে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় কয়েক ডজন পরিবার প্রাণের ভয়ে নিজ বাসভূমি ত্যাগ করে এই শহর হয়ে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে যাচ্ছে।
আমি যখন তুরস্কে একটি ডকুমেন্টারি শ্যূটিংয়ের জন্য সময় কাটাচ্ছিলাম তখনই মূলত রেহানলি শহরটি আমার নজরে আসে। সেখানে রেদওয়ান আল সাঈদ নামের একটি বেকারির সন্ধান পাই আমি। অন্যান্য বেকারির তুলনায় ওই বেকারিটি যেমন ছিল ভিন্ন তেমনি এর কার্যক্রমও ছিল ব্যাতিক্রমি। রেদওয়ানে বিগত পাঁচ বছরে একদিনও বন্ধ ছিল কিনা তা বলা যাবে না। চব্বিশ ঘণ্টা বেকারিটি খুলে রাখার জন্য বেশ কয়েক কর্মপ্রহরে কর্মীদের কাজে লাগানো হয়। আর এই বেকারিটি থেকে প্রতিদিন প্রায এক লাখ সত্তর হাজার রুটি তৈরি করা হয়, যা সিরিয়ার বিভিন্ন পরিবারে নিয়মিত খাবার হিসেবে যায়।
প্রথমে ভেবেছিলাম যে বেকারি মালিক বুঝি এই মহৎ কাজটি দিনের পর দিন করে যাচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জানা যায়, তুরস্কের সবচেয়ে বড় ত্রান ফাউন্ডেশন ইনসানি ইয়ারদিম ভাকফি(আইএইচএইচ) কাতার চ্যারিটি ফাণ্ড থেকে এই বেকারিটিকে সহায়তা করছে। বেকারিটির অনেকের সঙ্গেই আমার কথা হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দিনের পর দিন কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সকলের কাছে খাবার(রুটি) পৌছে দেয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়।
মাঝে মধ্যেই আক্রমনের শিকার হয় বেকারিটি। কিন্তু এতোকিছুর পরেও একদিনের জন্যও বেকারিটি বন্ধ হয়নি। কারণ একদিন এই বেকারি বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে কয়েক হাজার পরিবারের খাবার বন্ধ হয়ে যাওয়া। দুবছর আগে অবশ্য একবার বেকারি কর্তৃপক্ষ চিন্তা করেছিল যে, বেকারিটি তুরস্কে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখান থেকেই যাদের প্রয়োজন তাদের মাঝে সরবরাহ করা হবে। তবে বিভিন্ন কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। তারপরেও এই বেকারি থেকেই সিরিয়ার আলেপ্পো, হোমস, ইদলিবসহ অন্যান্য স্থানে রুটি পৌছে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই বেকারিতে কর্তব্যরত শ্রমিকরা গত বছরগুলোতে একদিনও ছুটি নেয়ার কথা ভাবেনি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, যুদ্ধের মাঝে আটকে থাকা মানুষগুলোর যন্ত্রনা তাদের যন্ত্রনার থেকে আরও অনেক বেশি। সেই যন্ত্রনার পাশে সামিল হতেই তারা নিয়মিত রুটি বানিয়ে যায়।
আমার সঙ্গে কথা হয় বেকারি মালিক রেদওয়ান ও তার পরিবারের সঙ্গে। বেকারির ঠিক পিছেই একটি ছোট্টো ঘরে বাস করেন তারা। রেদওয়ানের পরিবারের সঙ্গে দেখা হলে আমাকে এবং আমার ক্রুদের তারা চা আর রুটি দিয়ে আপ্যায়িত করে। যুদ্ধ, সিরিয়া-তুরস্ক ইত্যাদি বিষয়ে কথা হয় পরিবারটির সঙ্গে। রেদওয়ানের গলায় অবশ্য যুদ্ধের ক্ষতগুলো ফুটে ওঠে ভিন্ন মাত্রায়। দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চলার কারণে অনেক মানুষই তাদের আবাসন হারিয়েছে। সেই আবাসন হারাদের মধ্যে অনেকেই রাস্তায় দিন কাটাচ্ছে। আজকে হয়তো রেদওয়ানের অবস্থা অন্যদের তুলনায় কিছুটা ভালো কিন্তু এই ভালো অবস্থাই বা কয়দিন থাকবে তা রেদওয়ান ও তার পরিবার জানে না।
মন্তব্য চালু নেই