ব্রাজুকার ব্রাজিলে রসনার বাসনা
দিলীপ মজুমদার (কলকাতা): আশৈশব দেখা এ ছবি কত চেনা! উদাত্ত ভঙ্গিমায় ‘দুই হাত প্রসারিত’ যীশু। স্বয়ং ঈশ্বরপুত্রর উষ্ণ অভ্যর্থনা। প্লেনের জানলা দিয়ে সে আহ্বানের আভাস পেয়ে এ বঙ্গসন্তানের পুলকিত হওয়াই স্বাভাবিক ছিল।
হলও তাই। রিও-তে পা রাখলাম।
সুখ-সাম্বা-রিও
————
সুখের কি সংজ্ঞা হয়? কোনও নিরিখে আদৌ বিচার করা যায় আনন্দ-পরিমাণ? ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের নিক্তিতে কি মাপা যায় সুখ-সূচক? অন্তত ইউরোপীয় বা মার্কিনী হিসেব মাথায় রেখে রিও ডি জেনেইরো শহরে পা রাখলে, চমকাবেন। কোথায় ফুটেজে দেখা বিক্ষোভে জ্বলন্ত রাষ্ট্র? আনন্দলহরীতে যেন ভাসছে গোটা শহর। হ্যাঁ, দারিদ্র আছে, শহরের নানা জায়গায় সে দারিদ্রের ছাপও আছে, বস্তির অনুন্নয়ন-তাও আছে, এমনকী বিশ্বকাপের বাহানায় লক্ষ লক্ষ পর্যটকের হামলে পড়াতে বিরক্তিও আছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে আছে ওই সুখ-সাগরের উচ্ছ্বাস-ফেনা। মার্কিন অর্থনীতিবিদদের হিসেবে এ শহরর সত্তর শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। তবু রোদ-ঝলমল বিচ, রং-ঝকমক কার্নিভাল আর নেশা-চড়ানো সাম্বার তালে-তালে যাবতীয বিষন্নতা যে রিও শহরের কোন জানলা দিয়ে পালিয়েছে, তা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
সকার-সুগার লোফ-সান্টা তেরেসা
————————-
রজাক মুরের সেই ‘মুনরেকার’ মনে পড়ে? ১৯৭৯-তে দুনিয়া-কাঁপানো জেমস বন্ডীয় অ্যাকশন পটভূমিই তো ব্রাজিলের সুগার লোফ পর্বত আর এই কেবল-কার। তবে রিল লাইফের অ্যাকশনের থেকে ব্রাজিলের রিয়েল লাইফ অ্যাকশনও কম নয়। পৃথিবীজোড়া খ্যাতি পাওয়া ‘গ্রেট ট্রেন রবার’ রোনাল্ড (রনি) বিগস থাকতেন এই রিও শহরেরই সবচেয়ে বর্ণময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অংশে, যার নাম সান্টা তেরেসা। কুখ্যাত যে গ্যাং ১৯৬৩-র অগাস্টে ইংল্যান্ডে মেল ট্রেন থেকে প্রায় তিন মিলিয়ন পাউন্ড লুঠ করে, বিগস ছিলেন তাঁর মূল পান্ডা। ১৯৬৫-র জুলাই মাসে লন্ডনের সবচেয়ে সুরক্ষিত জেল ভেঙে গিবসের ফেরার হওয়ার গল্প প্রায় ‘মিথ’ হয়ে গেছে। এহেন ‘খ্যাতনামা’ রনি বিগস অস্ট্রেলিয়া হয়ে ব্রাজিলের রিও-তে পা রাখেন ১৯৭০-এক মার্চে। মারাত্মক অসুস্থ হয়ে ২০০১-এর মে –তে ব্রিটেনে ফেরা অবধি গিবস ব্রাজিলেই ছিলেন এবং সান্টা তেরেসা এলাকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ হিসেবে রীতিমতো ‘হিরো ওয়ারশিপ’ চলত তাঁকে নিয়ে। মজার কথা, ১৯৮১-তে আরেকটি গোষ্ঠীর গুণ্ডারা রনিকে কিডন্যাপ করে এই সুগার লোফ পাহাড়ের কেবল-কার স্টেশনের গায়ের একটি রেস্তোরাঁ থেকে। আর তখন ওখানেই শুটিং চলছিল ওই রজার মুরের ‘মুনরেকার’ ছবির। অপহরণকারীরা প্রত্য়েকে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে এই শুটিং-টিমের সদস্য় সেজেই দুষ্কর্মটি সারে।
রিও-র এহেন ঘটনাবহুল জীবনযাত্রা বিশ্বকাপের ব্রাজিলে যে কিছুটা বাড়তি স্বাদ যোগ করবে, তাতে আর সন্দেহ কী? কলকাতার ট্রামের ধরনের সান্টা তেরেসা ট্রলিতে চড়ে মনে পড়ল ইন্টারনেটে পড়েছিলাম, এই ট্রলি বিখ্যাত হয়েছে রনি বিগসের উত্তরাধিকারীদের জন্য। মজাদার এই ট্রলি-রাইডে মাতোয়ারা পর্যটকদের মধ্যে অনেককেই হারাতে হয় পার্স, মোবাইল বা ক্যামেরা।
ভিড় করা হুল্লোড়বাজ সুবেশ যাত্রীদের অনেকেই যে পকেটমার! এদেশে রনি বিগসকে নিয়ে যে বীর পুজো হবে, তাতে আর সন্দেহ কী!
তবে বেশিক্ষণ নয়, ‘হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ’-এর এ টেনশন ভুলিয়ে দেবে ট্রলির খোলা জানালা দিয়ে দেখা অনির্বচনীয় দৃশ্যাবলী-রং-রূপ-উষ্ণতায়। আর আপনিও অবধারিতভাবে মেতে উঠবেন আবিষ্কারের আনন্দে।
আবিষ্কারের এহেন অনুষঙ্গেই মনে পড়ে গেল পৃথিবীর সমস্ত কৌতূহলী পর্যটকের পূর্বসূরী ভাস্কো-দা-গামার কথা!
মন্তব্য চালু নেই