রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভারত কেন চুপ?
গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সীমান্তবর্তী তিনটি চেকপোস্টে অস্ত্রধারীদের হামলায় দেশটির নয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এই রাজ্যটিতেই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বাস, যাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেন না মিয়ানমারের শাসকেরা। রোহিঙ্গারা সেখানে দীর্ঘদিন থেকে বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে।
৯ অক্টোবরের হামলার পর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর অভিযান শুরু করে। এরপর থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সন্দেহভাজনদের ওপর নির্বিচারে গুলি, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, সম্পদ লুট, খাদ্যের মজুত বিনষ্ট, এমনকি নারীদের ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ কারণে বহু লোক বাস্তুচ্যুত হয়। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে বাস করা এই রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজেদের মিয়ানমারের আদিবাসী সংখ্যালঘু বলে বিবেচনা করে থাকে। তবে বৌদ্ধ-অধ্যুষিত মিয়ানমারের শাসকেরা তাদের বাংলাদেশি অভিবাসী আখ্যা দিয়ে থাকেন। নাগরিকত্ব, মুক্ত চলাচল, কাজের সুযোগ, সরকারি চাকরি এবং ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে রোহিঙ্গাদের। ২০১২ সালের জুন ও অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সংকট একটি নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আর এই ইস্যুতে নীরব রয়েছে ভারত। এ বিষয়ে ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে নিবিড়ভাবে গবেষণা করা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কে ইহোম বলছেন, ‘এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান এই যে বিষয়টি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ তবে তিনি উল্লেখ করেন, এই ইস্যুতে দিল্লি সতর্ক অবস্থা বজায় রাখলেও গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণ করেছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের বসবাসের সুযোগ দিয়েছে। ২০১২ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ ওই রাজ্য পরিদর্শন করেন এবং ত্রাণ হিসেবে ১০ লাখ ডলার দেন।
তবে গত কয়েক মাসে রাখাইনে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর দিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
কেন এই নীরবতা?
মিয়ানমার সম্পর্কে অভিজ্ঞ ভারতের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি অত্যন্ত জটিল। তিনি বলেন, ‘এর সঙ্গে প্রকৃত অর্থেই তীব্র আবেগ জড়িত। সেখানে রোহিঙ্গাদের শ্রেণিবদ্ধকরণ নিয়েই সামগ্রিক একটি বিতর্ক রয়েছে। এখানে তথ্যেরও ঘাটতি রয়েছে। সমস্যাটি কেবলই মিয়ানমারের এবং এর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্কই নেই-এ ধরনের কোনো সমাধান ইয়াঙ্গুনের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমার মতে, এই সমস্যাটি মীমাংসাযোগ্য নয়।’
ওই কর্মকর্তা যুক্তি দিয়ে বলেন, এই ইস্যুতে ভারতের জড়ানোর ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘যদি আপনার কাছে কোনো সমাধান বা ভালো প্রস্তাব দেওয়ার কিছু না থাকে, তবে আপনার এ থেকে দূরে থাকাই যৌক্তিক।’
আরেক কর্মকর্তা বলছেন, ‘এমন নয় যে ভারত মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর আচরণকে প্রভাবিত করার মতো সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কাজেই যেকোনো ইস্যুতে তারা কেন আমাদের কথা শুনবে?’
তবে ভারতের এ সতর্কতার আরও অনেক কারণ রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের দ্বিধান্বিত নীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেজি ইন্ডিয়ার কনস্ট্যানটিনো জেভিয়ার। জেভিয়ার বলেন, মিয়ানমারের নতুন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার গুরুত্ব থেকেই দিল্লির এই নীরবতা। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে চীনকে দূরে রাখা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির ক্ষেত্রে মিয়ানমারের গুরুত্ব রয়েছে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেশের মানুষের কাছেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের মতো ঘটনার চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কে ইহোম বলেন, ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনকে দমন করার জন্য সামরিক জান্তার সমালোচনা করে ভারত। এ কারণে বছরের পর বছর ধরে ওই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব বজায় ছিল। চীন অনেক দিক থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এ পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লি পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে বিনিয়োগ করছে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীকে নাখোশ করাটাকে কৌশলগত ভুল হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের জনগণ কীভাবে দেখে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এই ইস্যুতে যেকোনো ধরনের সমালোচনা মিয়ানমারের কাছে বিরাট অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
এ ছাড়া ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থও রয়েছে, যা নির্ভর করছে মিয়ানমারের শাসকদের সদিচ্ছার ওপরও। ২০১৫ সালে মণিপুরে নিরাপত্তা বাহিনীর বহরের ওপর নাগা বিদ্রোহীদের হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর ভারতীয় বাহিনী ইয়াঙ্গুনের নীরব সম্মতিতে মিয়ানমারের সীমান্তে গোপন অভিযান চালায়। ওই সমঝোতা ক্ষতিগ্রস্ত হোক ভারত তা চায় না।
ইহোম বলেন, এ ছাড়া ভারত দেশটিতে সফল রাজনৈতিক পালাবদল চায় এবং উদীয়মান গণতন্ত্র হিসেবে দেখতে চায়। মিয়ানমারকে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিতে চায়। আর তাই লাভ-ক্ষতির হিসাবে ভারত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে নীরবতাই বাঞ্ছনীয়।
মন্তব্য চালু নেই