সাগরে ভাসমান অবস্থায় ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানালেন বাংলাদেশি তরুণ

ইন্দোনেশিয়ার সীমান্ত সাগরে ভাসমান অবস্থায় খাদ্যভাবে এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা জানালেন বাংলাদেশি তরুণ ওসমান হারুনি। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের লাংসা শহরের আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি।

২২ বছর বয়সী এ তরুণ জানান, আমি জানতাম খাবার শেষ হয়ে যাবে এবং আমরা বিপদে পড়বো।

তিনি বলেন, আমাদের কাঠের নৌকায় প্রায় ৮০০ জন বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা ছিল। যাত্রা শুরুর কিছুদিন পরেই আমাদের খাবার শেষ হয়ে যায় এবং নৌকার পরিস্থিতি বদলে যায়।

মুহাম্মদ আলমগীর এবং শহীদুল ইসলাম নামে তার দুই বন্ধুর সঙ্গে নৌকায় ছিল হারুনি। তিনি বলেন, নৌকায় রোহিঙ্গারা অস্ত্র হাতে আধিপত্য বিস্তার করছিল। তারা বাংলাদেশিদের অনেক মারধর করছিল এবং কখনো কখনো বাংলাদেশিদের পানিতে ফেলে দিচ্ছিল।

হারুনি বলেন, “আমি দেখলাম দুইজন ব্যক্তি শহীদুলের পা ধরে টেনে নিয়ে সাগরে ফেলে দিল। এরপর আলমগীরকেও পেছন থেকে একজন ধাক্কা দেয়। আমি জানতাম যে, সে সাঁতার জানে না।

আলমগীর বলেন, “আমি যখন পানিতে ছিলাম, আমি ভেবেছিলাম আমি বোধ হয় মারাই যাচ্ছি। একটা সময় আমি দেখতে পেলাম হারুনি আমার দিকে সাঁতরে আসছে। সে আমার শার্টের কলার ধরে আমাকে টেনে তোলে এবং আমি প্রাণ ফিরে পাই।”

ওসমান হারুনি তার দুই বন্ধুর সঙ্গে কক্সবাজারে ছুটি কাটাতে গিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই জানায়, দেশত্যাগের তাদের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

১৮ বছর বয়সী শহীদুল ইসলাম বলেন, “আমরা আসলে সেখানে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম। একদিন হঠাৎ একজন ব্যক্তি এসে বলে আমাদের বন্ধু হতে চায়। এরপর সে একদিন আমাদেরকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানায়। আমরা তার বাসায় গেলে সে আমাদের একটি ঘরে লক করে ফেলে। এর কিছুদিন পরে তিনবন্ধু নিজেদেরকে একটি নৌকায় আবিষ্কার করেন। সেখানে ১৫০ জনের মতো বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা ছিল। তারা প্রত্যেকেই পা ফাঁক করে বসেছিল যেন সামনে আরেকজনের বসার জায়গা হয়।’

হারুনি বলেন, এভাবে বসে থাকতে থাকতে আমাদের পা ফুলে গিয়েছিল। আমরা ঘুমুতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমরা নরকে বাস করছিলাম।

নৌকায় কাটানো এই দীর্ঘ সময় শুধু মা এবং ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল বলে জানালেন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বাস করা এ তরুণ।

হারুনির এ অভিজ্ঞতা আসলে সাগরে ভাসমান সকল অভিবাসীদের নারকীয় অভিজ্ঞতার চিত্রই ফুটিয়ে তোলে। গত ১০ দিনে আড়াই হাজারেরও বেশি অভিবাসী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যাণ্ডে আশ্রয় নিয়েছে। তবে এখনও সেখানে কয়েক হাজার অভিবাসী খাবার ও পানির তীব্র সংকট নিয়ে সাগরে ভাসমান অবস্থায় আছে।

উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিরা বলেন, আমাদের নৌকা মার্চের মাঝামাঝি দিকে থাইল্যান্ডে এসে পৌঁছায়। এসময় পাচারকারীরা জানায় বাংলাদেশে তাদের এজেন্টকে ২ লাখ টাকা করে পৌছে দিলে তাদের সবাইকে মুক্তি দেয়া হবে। কিন্তু টাকার ব্যবস্থা করার পরও তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়নি। একদিন সকালে তারা উঠে দেখে পাচারকারীরা পালিয়ে গেছে।

যাওয়ার আগে তাদের একটি বড় নৌকায় রেখে যাওয়া হয় যেখানে প্রায় ৭০০ জন অভিবাসী ছিল। তখন তারা বুঝতে পারে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। কিছুদিন পরই তাদের নৌকা ডাঙায় পৌঁছায় এবং নৌবাহিনী তাদের তাড়িয়ে দেয়।
অন্যদিকে কিছু রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, কিছু নৌকায় বাংলাদেশিরাও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে একই আচরণ করত।

সুখতারা নামে এক রোহিঙ্গা নারী জানান, তিনি তার দুই সন্তান নিয়ে মালয়েশিয়ায় তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নৌকায় তার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান নৌকায় খাবার নিয়ে সহিংসতায় আহত হয়।

তিনি বলেন, “আমরা হয়তো সেদিন মারাই যেতাম। কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ সেদিন ইন্দোনেশিয়ান জেলেরা আমাদের রক্ষা করেছিল।”

তবে তারা সকলেই জানিয়েছে, গত আড়াই মাসে খাদ্যাভাবে এবং সহিংসতায় শতাধিক মানুষ মারা গেছে।



মন্তব্য চালু নেই