সন্ন্যাসিনী ধর্ষণের ঘটনায় টলছে ভারত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গির্জার সন্ন্যাসিনী ধর্ষণের ঘটনায় টলছে ভারত। গত কয়েকদিনে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারিরা নারীর নিরাপত্তা দিতে ক্ষমতাসীনরা ব্যার্থ বলে স্লোগান তুলেছে। একই সঙ্গে এ ঘটনার ব্যর্থতার জন্য বিজেপি ও তৃণমূলকেও দুষছেন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের মিছিলে ‘বিজেপি-হার্মাদ অশুভ আতাঁত ধ্বংস হোক’ জাতীয় অজস্র প্ল্যাকার্ড শোভা পাচ্ছে।

এদিকে, এ ঘটনা নিয়ে ক্ষমতাসীনরাও জড়িয়ে পড়েছেন কাদা ছোঁড়াছুড়িতে। তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীতো এর জন্য বিজেপি-সিপিএমকে দায়িই করে বসলেন।

গত সোমবার রানাঘাটে বিক্ষোভকারীদের ঘেরাওয়ের মুখে পড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে এসেছিলেন, ‘এ কাজ সিপিএম এবং বিজেপির।’ তার পথে হেঁটেই এখন বিজেপি এবং সিপিএমের রাজনৈতিক ‘চক্রান্ত’কে সামনে আনতে মরিয়া নদিয়া তৃণমূল। রীতিমতো তালিকা তৈরি করে ফেলা হয়েছে বিক্ষোভকারীদের। দলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের কথায়, ‘যারা এটা ঘটিয়েছে, তৃণমূল তাদের সাংগঠনিক ভাবে চিহ্নিত করে মোকাবিলা করবে।’

অন্যদিকে, দেড় বছর আগে কামদুনিতে কলেজছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরে রানাঘাটের মতোই পথে নেমেছিল কামদুনি। গ্রামে পা-রাখা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদে সরব হওয়া টুম্পা এখন তিন মাসের ‘বিট্টু’র মা। কোলের ছেলেকে সামলাতে সামলাতেই তরুণী মা বলছেন, ‘কী আশ্চর্য! দেড় বছরে কিছুই বদলাল না। পরিস্থিতিও না, প্রশাসনও না!’ মৌসুমি কয়াল ফুঁসে উঠে বলছেন, ‘আমাদের গায়ে মাওবাদী-ছাপ্পা পড়েছিল! এখন রানাঘাটকে সিপিএম-বিজেপি বলা হচ্ছে।’ টুম্পা-মৌসুমি এখনও হাল ছাড়েননি। কিন্তু দেড় বছর আগের ঝাঁঝালো ক্ষোভ এখন দীর্ঘশ্বাসে মিশে যাচ্ছে। শাসক দলের নিরন্তর চাপের মুখে গ্রামের মানুষজনও গুটিয়ে গিয়েছেন।’

রানাঘাটে বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনীর ধর্ষণের ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। যদিও সিআইডি-র একটি সূত্রের দাবি, তদন্তের পথে সামান্য হলেও একটা দিশা মিলেছে। নদিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকার অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদের পরে মঙ্গলবার ঘটনাস্থল গাংনাপুরের এক যুবককে আটক করেছেন গোয়েন্দারা। যদিও তার সঙ্গে প্রকৃত অপরাধীদের যোগাযোগ কতটা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

কিন্তু এই সামান্য অগ্রগতিটুকু ছাড়া রাজ্য পুলিশের পক্ষে বলার মতো কিছু নেই। বরং, স্কুলের ভিতরে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ থেকে দুষ্কৃতীদের ছবি মেলা সত্ত্বেও তদন্তের এই হাল কেন, তা নিয়ে জনরোষ ক্রমশ বাড়ছে। সোমবার রানাঘাটে গিয়ে যার আঁচ কিছুটা উপলব্ধি করেছেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্নের অস্বস্তি বাড়িয়ে মঙ্গলবার তদন্তে স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন কলকাতার আর্চবিশপ টমাস ডি’সুজা। তার কথায়, ‘দুষ্কৃতীদের কি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? সমস্যাটা কী, প্রশাসন তা-ও জানাচ্ছে না।’ পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরেও পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের অদক্ষতা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।

রাজ্য পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ‘সিসিটিভি ফুটেজ থাকাটাই এ ক্ষেত্রে তদন্তকারীদের পক্ষে কাল হয়েছে।’ তাদের মতে, অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে জনরোষ চাপা দিতে পুলিশ ঘটনার পরপরই কয়েক জন দাগি অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে ফেলে ওই অপরাধের সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনও যোগাযোগ না-থাকা সত্ত্বেও।

এক প্রবীণ পুলিশ অফিসারের কথায়, ‘এতে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামাল দিয়ে পরে ধীরেসুস্থে প্রকৃত অপরাধীদের খোঁজ করা যায়। আর ওই দাগিরা পরবর্তীকালে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়।’ কিন্তু রানাঘাটের ঘটনায় সিসিটিভির ফুটেজ থাকায় যে কাউকে গ্রেপ্তার করে প্রকৃত অপরাধী বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।

এই অবস্থায় রাজ্যের সব পুলিশকর্মীই অন্য সব ছেড়ে রানাঘাটের দুষ্কৃতকারীদের খোঁজার কাজে মন দিয়েছেন বলে সেখানকার প্রশাসনিক সূত্রের খবর। এই ঘটনার তদন্তের ভার নেওয়া সিআইডির এডিজি রাজীব কুমার নিজেই গত চার দিন ধরে রানাঘাটে রয়েছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন আরও কয়েক জন পদস্থ অফিসার। কিন্তু তার পরেও তদন্তের এক চুল অগ্রগতি না-হওয়াটা রাজ্য পুলিশের পক্ষে যে মোটেই ভাল বিজ্ঞাপন নয়, তা মানছেন প্রশাসনের বহু কর্তাই।

সন্ন্যাসিনীর ধর্ষণ নিয়ে কী ভাবে এগোতে চাইছেন গোয়েন্দারা? সিআইডি সূত্রের খবর, সিসিটিভি থেকে পাওয়া দুষ্কৃতকারীদের ফটো রাজ্যের জেলবন্দি দাগি অপরাধীদের দেখানো হয়েছে। দেখানো হচ্ছে অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনকেও। গাংনাপুর এলাকার পুরনো কিছু দুষ্কৃতকারীর বিষয়েও খবর নেয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, এই পদ্ধতিতে তদন্ত করে নদিয়ার দাগি অপরাধীদের কাছ থেকে ক্ষীণ সূত্র মিলেছে। সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে চাকদহের এক দুষ্কৃতীর চেহারার মিল রয়েছে জানিয়ে ওই অপরাধীরা বলেছে, ডাকাতি করতে গিয়ে ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি করার অভ্যাস রয়েছে ওই ব্যক্তির। তাই তারা আর ওই দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। ওই ব্যক্তি ২০১১-১২ সালে গাংনাপুর ও খড়দহ থানায় ডাকাতির মামলায় ধরা পড়েছিল। তার সঙ্গে রাজ্যের এবং বাংলাদেশের দুষ্কৃতকারীদের সম্পর্ক রয়েছে বলেও প্রাথমিক ভাবে জানা গেছে। ওই ব্যক্তিকে আটক করে জ্ঞিাসাবাদ করা হচ্ছে।

কলকাতা সিআইডি সূত্রের খবর, সিসিটিভি থেকে পাওয়া দুষ্কৃতকারীদের যে ফটো ও স্কেচগুলি সোমবার প্রকাশ করা হয়েছে, তার পাঁচ নম্বরে থাকা দুষ্কৃতকারীই সে দিনের ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছিল। তার নির্দেশেই প্রথমে স্কুলের নিরাপত্তা রক্ষীর হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। তার পর অন্য সন্ন্যাসিনীদেরও সে-ই ঘরে আটকে রাখার নির্দেশ দেয়। আর তালিকার ছয় নম্বরে থাকা দুষ্কৃতকারী অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ করেছিল বলে গোয়েন্দা সূত্রের দাবি।

সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, রানাঘাটের গাংনাপুরের কনভেন্ট স্কুলে ডাকাতি ও বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সোমবারই রাজ্যের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে। এবার সক্রিয় হলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের পক্ষে টুইট করে বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ঘটনায় মোদী উদ্বিগ্ন। তিনি এ ব্যাপারে রাজ্যের কাছে তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছেন। রাজ্য সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা-ও জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

শুক্রবার গভীর রাতে রানাঘাটের ওই স্কুলে সাত দুষ্কৃতকারী ঢুকে যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তা প্রকাশ্যে আসতেই কার্যত গোটা বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তৎপর হয় কেন্দ্রও। নর্থ ব্লকের খবর, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে নবান্নর কাছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রুখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্তরেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ না রেখে আরও এক ধাপ এগিয়ে এবার সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে।

এর ফলে গোটা ঘটনাটি অন্য মাত্রা পেতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য, বৃদ্ধা খ্রিষ্টান সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ করার ঘটনাটি শুধু রাজ্যেরই নয়, গোটা দেশের মুখ পুড়িয়েছে। এমনিতেই ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভাবমূর্তির কিছুটা সমস্যা রয়েছে মোদী সরকারের।



মন্তব্য চালু নেই