লেবাননে বাংলাদেশী নারীর কান্না: ম্যাডামের স্বামী আমার স্তন স্পর্শ করতো, জড়িয়ে ধরতো…
লেবাননে বাংলাদেশী নারী শ্রমিকরা নীরবে কাঁদছেন। গত ১৪ জানুয়ারি কাফা ও লিগ্যাল এজেন্ডা নামে দু’টি সংস্থা যৌথভাবে বাংলাদেশ ও নেপালের নারী শ্রমিকদের ওপর একটি সমীক্ষা করেছিল।এটি বেরিয়েছিল আরবি ভাষায়। সম্প্রতি এর একটি সংক্ষিপ্তসার ইংরেজিতে তরজমা করে প্রকাশ করেছে আল মনিটর নামে একটি ওয়েবসাইট।
ওই সমীক্ষা বলেছে, নেপালি নির্যাতিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা যেখানে ১৪ সেখানে ৫৮ ভাগের বেশি বাংলাদেশী নারী শ্রমিক বলেছে, তারা তাদের চাকরিদাতা, তাদের আত্মীয়স্বজন এবং লেবাননের নিয়োগকারী অফিসের লোকজনের কাছ থেকে দৈহিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
উল্লেখ্য, কাতার ও আরও কয়েকটি দেশ কাফালা বিলোপে উদ্যোগী হলেও লেবাননে কাফালা কঠোরভাবে আরোপিত রয়েছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী নারী শ্রমিকের দেশ লেবানন। সংখ্যায় তারা প্রায় দু’লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার গৃহপরিচারিকা।
অন্যদিকে ১৪ ভাগ নেপালি বলেছে তারাও নির্যাতনের শিকার। আর ৮২ ভাগ নারী বলেছে, তাদেরকে তাদের মতের বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এর মধ্যে ৬২ ভাগ নারী প্রতিদিন ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করেন।
১৭ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন এমন নারীর সংখ্যা ৫৩ ভাগ।
এসব নারী শ্রমিকের ৫৪ ভাগের বেতন এক মাস বা তার বেশি সময়ের জন্য বাজেয়াপ্ত থাকে। তাদের ৯০ ভাগকে কখনও একা বাইরে যেতে দেয়া হয় না।
৯১ ভাগকে সাপ্তাহিক ছুটির অধিকার নাকচ করা হয়। ৫০ ভাগের বেশি শ্রমিক বলেছে, তাদেরকে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ অবস্থায় কাজ করতে হয়। ৬২ ভাগ শ্রমিকের মধ্যে ১৯ ভাগ নারী রান্নাঘরে ঘুমান। ব্যালকনিতে ৭ ভাগ।
বাচ্চা বা প্রবীণদের সঙ্গে থাকেন ১১ ভাগ। ২২ ভাগ থাকেন লিভিং রুমে। অনেকে বলেছেন তাদেরকে বাথরুমের কাছেও ঘুমাতে বাধ্য করা হয়।
৩২ ভাগ ভাল ও পর্যাপ্ত খাবার পান না।
একজন শ্রমিক বলেছেন, তাকে কুকুরের খাবার খেতে বাধ্য করা হয়েছে। ১০ ভাগ নারী যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
গত বছরের জুলাইয়ে লেবাননে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস খোলা হয়। এর আগে জর্দানের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ভিসা ও পাসপোর্ট ইস্যু করা হতো।
গত ২৫ মার্চ লেবানের ডেইলি স্টারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকার বলেন, বাংলাদেশী শ্রমিকদের সাধারণভাবে আমরা ভালই দেখি। কিন্তু অনেক সময় আমরা নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ পাই। অনেককে অতিরিক্ত কাজ করানো হয়। আরও নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়, যা লেবানন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের আলোচনা করতে হয়।
‘কাফালা’র দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘সমস্যা আরও স্তরে আছে। নিয়োগের জন্য বাছাই থেকে শুরু করে তাদেরকে লেবাননে অভ্যর্থনা জানানো পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে সমস্যা আছে।’
উল্লেখ্য, লেবাননে গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে বাংলাদেশী সংস্থা প্রতিবাদে সোচ্চার না হলেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন সোচ্চার রয়েছে।
২০০৮ সালের আগস্টে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে লেবাননে ৯৫ জন গৃহপরিচারিকা আত্মহত্যা করেছে।
অজন্তা এখন: ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ইকুয়াল টাইমস ডট অর্গে আইদান ম্যাকোয়েদ এক ‘অজন্তা’র কাহিনী প্রকাশ করেছিলেন।
তার বিবরণ: অজন্তা (প্রকৃত নাম নয়) বাংলাদেশের এক গরিব ঘরের মেয়ে। তিনি লেবাননে চাকরি নিয়ে আসেন। কারণ তিনি তার ছেলের স্কুল খরচ চালাতে চেয়েছিলেন। ছেলেকে আইনজীবী করবেন। যাতে ছেলে বড় হয়ে আইনজীবী হয়, তার মতো মহিলাদের পাশে দাঁড়ায়। অজন্তা বয়স সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেন। কারণ ২৫ বছরের নিচে হলে বিদেশে নারী শ্রমিক হওয়া যায় না।
‘‘আমি কাজ পেয়েছিলাম বৈরুতের এক সচ্ছল নারী ডাক্তার পরিবারে। প্রথম দিনেই ম্যাডাম ডাক্তার আমার পাসপোর্ট ও চুক্তিপত্র কেড়ে নেন। আমার মনে হলো আমাকে যেন বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। থালাবাসন মাজা থেকে রাজ্যের সব কাজ আমাকে করতে হতো। আর দিন দিন তা বাড়ছিল। প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছে। এটা আমাকে দুর্বল ও রুগ্ণ করে তোলে। আমাকে মৌখিক রূঢ় আচরণ ও মাঝে মধ্যে দৈহিক নির্যাতন সইতে হতো। যেদিন কফি দিতে দেরি হতো, সেদিন আমাকে থাপ্পড় মারা হতো। একদিন এত জোরে আমার কানে থাপ্পড় দেয়া হলো যে, প্রায় ২০ মিনিট লাগলো স্বাভাবিক হতে।
রাতে ডাক্তারের ছোট ভাই আমার ঘরে আসতেন এবং নিপীড়ন চালাতেন। তিন বছর পরে আমি পালালাম।
বৈরুতের শাবারায় এখন অজন্তা একটি ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। দিনে গৃহপরিচারিকা, রাতে যৌনকর্মী।
‘‘এরকম একটি চরম অবস্থার মধ্যেও আমি লেবানন ছেড়ে আসতে পারি না। কারণ, আমার পাসপোর্ট সেই মহিলা ডাক্তার আটকে রেখেছে। কারণ হলো লেবাননি কাফালা। তবে সেখানে থেকে পালিয়ে এসে আমি বেশি স্বাধীনতার জীবন পেলাম।
আমার সন্তানের জন্য আমি অর্থ জমাতে পারি। আগে যেটা পারতাম না। এখন আমি সেটা পারি। কাজের অবসরে ছেলের কাছে ফোন করি। বাংলাদেশে সে ভালভাবে পড়ছে। ছেলের সঙ্গে কথা বলার পর মনে এত জোর পাই যে, সব ভুলে যাই। দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করি।”
ওই সমীক্ষার বরাতে দু’টো কাহিনী প্রকাশ পেয়েছে। ‘আমার ম্যাডাম আমার গায়ে কখনও হাত তোলেননি। কিন্তু তার স্বামী আমার উপর যৌন নির্যাতন করেছে। তিনি আমাকে তার শরীর ম্যাসাজ করে দিতে বলতেন। আমার স্তন স্পর্শ করতেন। ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরতেন…। তিনি আমাকে হত্যার হুমকি দিতেন, যদি তা আমি ম্যাডামকে বলে দেই। তিনি ছিলেন দীর্ঘকায়। টেকো।’
রত্না। বাংলাদেশ থেকে আসা এক নারী শ্রমিক। তিনি গৃহ ছেড়ে পালান। কারণ ময়লা ফেলার ঝুড়িতে যে খাবার রাখা হতো, তা দিয়ে তার আহার চলছিল না। ‘তারা আমাকে বেশ প্রহার করেছে। কিন্তু সব ধরনের নিগ্রহ সত্ত্বেও তারা যদি আমাকে খাদ্য দিতো তাহলে আমি পালাতাম না।’
এই সমীক্ষা চালিয়েছে কাফা নামে বৈরুত ভিত্তিক একটি সংগঠন। গত জানুয়ারিতে তারা লেবাননে বিদেশী নারী শ্রমিকদের ওপর একটি সম্মেলন করে।
এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সরকার নারী শ্রমিকদের বিষয়ে যেসব নীতি অনুসরণ করছে এবং সিভিল সোসাইটি ও এনজিও যেমনটা চাইছে তার মধ্যে বিরাট পার্থক্য।
ওই সম্মেলনে লেবাননি শ্রমমন্ত্রী সেলিম জেরিস এমন একটি চিত্র তুলে ধরেন যা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে।
মন্তব্য চালু নেই