‘রোহিঙ্গাদের উপর যুদ্ধ চালাচ্ছে মিয়ানমার’
মুসলিম সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিপীড়নের বিষয়টা অস্বীকার করে আসছিল বিভিন্ন মহল। মূল ধারার অনেক গণমাধ্যম নতুন বধূর মতো লাজুকতা নিয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে আসছে। মুখ দিয়ে ভাসুরের নাম নিতে লজ্জা পাচ্ছিলো যেন। আবার রোহিঙ্গাদের উপর সামরিক অভিযান চালানো জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়ে আসছে অনেক রাজনৈতিক কর্মী কিংবা ফেসবুকার।
অথচ নির্বিচারে নারী, শিশু ও বেসামরিক রোহিঙ্গাকে গুলি করে মারছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া অংসান সুচি যেন সব কানে তুলা দিয়ে রেখেছেন। সুচির নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে অনেকে।
সে যাই হোক বিশ্বের মোড়ল মিডিয়াতে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ২১ নভেম্বর (সোমবার) একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। এর শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গাদের উপর যুদ্ধ চালাচ্ছে মিয়ানমার’। যারা সন্দেহ করছিলেন বা যারা মনে করেছিলেন রোহিঙ্গা নিধনের খবরটি সঠিক নয় তারা এ সম্পাদকীয়টি পড়তে পারেন। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস্ও ধোয়া তুলসী পাতা না হলেও একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর সম্পাদকীয়র শুরুতে বলা হয় ‘দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর অনেক দিন ধরেই নিপীড়ন চালিয়ে আসছে মিয়ানমার। তাদেরকে নাগরিকত্বের মৌলিক অধিকারগুলো দিচ্ছে না, বিয়ে, ধর্মচর্চা এমনকি শিক্ষার সুযোগও দিচ্ছে না।’
২০১২ সালে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের চরমপন্থীরা রোহিঙ্গাদের উপর হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল। হাজার হাজার রোহিঙ্গা তখন বসতভিটা ছেড়ে সমুদ্রে ভাসতে থাকে। ওদিকে বাংলাদেশে ভিড়তে বাধা দেয় বিজিবি। দুই রাষ্ট্রের মাঝখানে দাড়িয়ে কাঁদছে বিপন্ন মানবতা। প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা খুবই মানবেতর পরিবেশে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করে আসছে।
আবার নতুন করে শুরু হওয়া সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে সেসব রোহিঙ্গাদের। গত ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসী হামলায় নয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার জবাবে সেনাবাহিনী এই অভিযান শুরু করে। সেই অভিযানে বেসামরিক রোহিঙ্গারা হতাহতের শিকার হচ্ছেন এবং তাদের বাস্তুভিটা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা যায় শনিবার বেলা ২টায় বলি বাজার ২৪ ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের শতাধিক মিয়ানমার সেনা দুদান গ্রামের ছোট্ট এলাকা খায়েন চংয়ে অভিযান চালায়। আগের দিন তারা কিয়েটিয়েপায়েন (স্থানীয় নাম কিয়েরি ফেরাং) গ্রামে যে তাণ্ডব চালায় তাতে ভীত ছিল খায়েন চং এলাকার বাসিন্দারা। তাদের এলাকায় অভিযানের খবরে বাসিন্দারা সেনাবাহিনীর হাতে আটক, নির্যাতন, ধর্ষিত এবং নিহত হওয়ার ভয়ে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করতে থাকেন। ওইদিন কাউকে আটক করতে ব্যর্থ হয়ে সেনাসদস্যরা বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়, মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে। বিকেল চারটার দিকে সেনাবাহিনী খায়েন চং এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পরে তারা দুদান গ্রামে অভিযান চালায়। সে গ্রামের মানুষও পালাতে শুরু করে। নারীরা বার্মিজ সেনাদের হাতে ধর্ষিত হওয়ার ভয়ে পালাচ্ছিল। তাদেরই একজন উবাইদা।
নদী সাঁতরে সৈন্যদের কাছ থেকে দূরে চলে এসেছিলেন বলে মনে করেছিলেন ওই তরুণী। কিন্তু গুলির সীমানা অতিক্রম করতে পারেননি তিনি। রাইফেলের গুলি এসে লাগে তার গায়ে। গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে পাশের ধানক্ষেতে কাতরাতে থাকেন উবাইদা (১৮)।
সাতার কেটে নদী পার হওয়া কয়েকজনের মধ্যে একজন বাইশ বছর বয়সী ইউনুছ সৈন্যদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর গুলিতে আহত উবাইদা তখনও শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছিলেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সাঁতরে আসে তিন সেনা সদস্য। এবার খুব কাছ থেকে গুলি করে রোহিঙ্গা তরুণীর মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। তারপর লাশটি নিয়ে চলে যায়। স্থানীয় সময় বেলা ৬টার দিকে গ্রামটি ছেড়ে যাওয়ার আগে উবাইদার লাশটি একটি রোহিঙ্গা বাড়িতে ফেলে যায়।
উবাইদার মর্মান্তিক ঘটনাটি খুব কাছ থেকে দেখেন পাশ্ববর্তী একটি গোপন জায়গায় লুকিয়ে থাকা এক রোহিঙ্গা। মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরা এই রোহিঙ্গার বরাত দিয়ে গণমাধ্যম জানায়, উবাইদার পাশে সাঁতার কাটার সময় আরও দুজন শিশু হারিয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, সেনাদের গুলিতে ওই দুই শিশুও মারা গেছে। এছাড়া আরও কয়েকজন নারীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত শতাধিক বেসামরিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে, আটক করেছে আরও এক হাজার। সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষিত হয়েছে ৮০ জন রোহিঙ্গা নারী। সেনারা তিন হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে এবং ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করেছে।
গণমাধ্যম প্রবেশ করতে বাধা প্রদানসহ সেনা অভিযানের কথা অস্বীকার করা হলেও স্যাটেলাইটে তোলা ছবি দেখে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ জানায় ২২ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বরের মধ্যে রাখাইন রাজ্যে কমপক্ষে ৪৩০টি বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের উপর হত্যাকাণ্ড, ধর্ষনের খবর পাওয়া গেলেও সরকার অস্বীকার করে আসছে। ৯ অক্টোবরের সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে তদন্তকারী দলের প্রধান ইউ অং উইন বলেন সৈন্যরা রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করবে না কারণ ‘তারা খুব নোংরা।’
কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমস এর সম্পাদকীয়তে বলে, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক বেসামরিক লোক হত্যা এবং নারীদের ধর্ষণের পর্যাপ্ত এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে।’
ডেমোক্রেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস পার্টির চেয়ারম্যান ইউ কিয়াও মিন অভিযোগ করেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে কমিয়ে আনার জন্য এই অভিযান চলছে।’
নিউইয়র্ক টাইমস-এর ওই সম্পাদকীয়তে বলা হয় মিয়ানমার সরকার ‘অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ’ করার কথা বলে রাখাইন রাজ্যের ২৫০০টি ঘরবাড়ি, ৬০০টি দোকান, কয়েক ডজন মসজিদ এবং ৩০টি স্কুল ধ্বংস করে দিয়েছে।
মন্তব্য চালু নেই