রত্নে ভাগ্য বদলাচ্ছে, কিন্তু কাদের ?

কার্পেট ব্যবসায়ী আলী মোহাম্মদ। কিছুদিন ধরে একের পর এক জটিলতা দেখা দিচ্ছে তার। বায়তুল মোকাররমের পাশের ওভারব্রিজের নিচে চা খাচ্ছিলেন জীবন-যন্ত্রণায় জর্জরিত আলী। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক তার সমস্যার কথা জানতে চাইলেন। আলী তার সাথে গল্প করতে করতে জানতে পারেন পাশে এক জ্যোতিষী আছেন। হাত দেখে রত্ন দেবেন আর আলীর মুশকিল আসান। হাত দেখাতে দেড় হাজার, পাথরের জন্য কুড়ি হাজার। জীবনের দুর্যোগ কাটাতে কত চেষ্টাই তো করেছেন আলী। নতুন করে একুশ হাজার পাঁচশ টাকা খরচে কী আসে যায়!

আলীর হাত দেখে জ্যোতিষী বলেছিলেন একটা পোখরাজ কিনতে হবে। জীবনের চড়াই উতরাই শেষ হয়ে যাবে। পাথর কিনলেন আলী। চলে গেল তিন মাস। এদিকে বদলে গেছে জীবন। আলীর নয়, ওই জ্যোতিষীর! আলীর জীবন যেমন ছিল তেমনই আছে। পাথরের বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে হাওয়া সেই ভাগ্যগণনাকারী। সঙ্গে গায়েব হয়ে গেলে সেই উদ্ধারকারী বয়স্ক ভদ্রলোকও।

শারমীন নাহারের দশ বছরের সংসার। নতুন করে দেখা দিচ্ছে দাম্পত্য কলহ। পারিবারিক অশান্তি আর মানসিক অস্থিরতা যখন তুঙ্গে, তখনই এক স্বর্ণের দোকানে যান ব্যক্তিগত কাজে। নানা কথা শোনার পর একটা পাথর নিতে বলে দোকানদার। তাকে বলা হয় মানসিক অস্থিরতা, দাম্পত্য কলহসহ আর্থিক টানাপড়েন এমনকি ব্যক্তিগত গোপন শত্রুতা কাটাতে অ্যাকুয়ামেরিন-এর বিকল্প নেই। এরপর যথারীতি চড়া দামে একটা পাথর কেনেন শারমীন। সাথে আঙটি বানানোর জন্য বাড়তি টাকা। সব মিলিয়ে দু’দফায় ৫০ হাজার টাকা যায় শারমীনের। একমাস অপেক্ষা করেও বদলালো না কিছুই। হাল ছাড়েননি শারমীন। আংটিওয়ালাকে ফোন করে নতুন পরামর্শ নেন। কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে কেনেন আরেকটা পাথর। আঙুলে পরাই সার হলো। কাজ হলো না কিছুই। পরেরবার ফোন করলে নম্বরটি বন্ধ পান শারমীন। বুঝতে পারেন পাথরগুলো ‘আসল’ নয়। বুকে পাথর চেপে ফিরে যান বায়তুল মোকাররমের দ্বিতীয় তলায়। দোকানের ভিড়ে ঠাহর করতে পারেন না কার কাছ থেকে কিনেছিলেন। যাকেই জিজ্ঞেস করেন সে-ই অস্বীকার করে।

বায়তুল মোকাররম মার্কেটের নামিদামি স্বর্ণালঙ্কারের দোকানগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ছোটখাটো অনেক দোকান এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে আসল-নকল পাথরের নানা ঠগবাজি। মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে চড়ামূল্যে বিক্রি করছেন পাথর। রমরমা ব্যবসা জ্যোতিষীদেরও।

ভ্রাম্যমাণ জ্যোতিষীদের পরে খুঁজে পাওয়াই যায় না। পল্টন ফকিরাপুল এলাকা থেকে জীবনের প্রতি হতাশ মানুষদের খুঁজে আনার জন্য আছে দালালের ছড়াছড়ি। সাদাচোখে এদের চেনা দায়। ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে কয়েকজনের সাথে কথা বললে পুরোটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এই এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনাপঞ্চাশেক দালাল আছে যাদের কাজ মূল খদ্দের ধরা এবং পুরনো খদ্দেরের অভিযোগ সামলানো।

হাসান এক চায়ের দোকানে বসে কথা বলেন একমাস আগে ৩০ হাজার টাকায় হাতে মুক্তা ধারণ করা সাহেব উদ্দিনের সাথে। পাথর নেওয়ার পর সাহেব উদ্দিনের ‘কাজ’ হয়নি। অভিযোগ নিয়ে এলে দালাল হাসান তাকে জ্যোতিষবিদ্যার নানা বিষয় বোঝাতে শুরু করে। দালালের যুক্তি-পাথরের ওপর ধারণকারীর সন্দেহ তৈরি হলে পাথর কিছুতেই কাজ করবে না।

ফল পেতে হলে বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। এমনটা জানার পর সাহেব উদ্দিন উঠে আসেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন এখানে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘কম টাকা আয় করি। বিপদের মুখে এই লোকের কথা শুনে একটা পাথর কিনছিলাম। কাজে দেয় না। পাথরের চকচকে ভাবটাও নাই।’ তাকে নিয়ে পাশের এক স্বর্ণের দোকানে গিয়ে পাথরটি আসল কিনা দেখে দিতে বললে দোকানি জানায় এ পাথরের দাম বড়জোর দেড়শ টাকা। ততক্ষণে বাইরে এসে দেখা গেল হাসানসহ সব দালাল উধাও।

আশেপাশের দোকানদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে মাঝেমধ্যেই পুলিশি তল্লাশি চলে। এখানে এমন অনেক লেনদেন হয় যেগুলোর সঙ্গে অসাধু স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও জড়িত। একটি স্বর্ণালঙ্কারের দোকানের মালিক সুমন বলেন, ভাগ্যের পরিবর্তন হবে ভেবে কত মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে তার ঠিক নেই। মার্কেটে রেপ্লিকা রত্নের সংখ্যা বেশি। ওগুলো অনেক সময় আসলটার চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হয়। আরেক দোকানী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সর্বস্বান্তরা পুলিশের কাছে যায় না। তাই ব্যবসাও রমরমা। মার্কেটের মালিকপক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞার ভেতর আনা হয় কিনা সে প্রশ্নে তিনি বলেন, এ মার্কেটে কেবল জ্যোতিষীদের নয়, স্বর্ণ কেনাবেচারও দালাল আছে। ঢালাওভাবে সবাইকে তো বের করে দিতে পারবে না।



মন্তব্য চালু নেই