যে স্থানের লোকজন এখনো ইঁদুর ধরে খায়, এটাই তাদের সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার!
ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে টেবিলে বা মেঝেতে যেন কোন খাবার পড়ে না থাকে। তা না হলে কিছু অনাকাঙ্খিত অতিথি আপনার ঘরের চেহরাই বদলে দিবে। এরকম বিদ্রোহ করার জন্য একটি মাত্র প্রাণিই যথেষ্ট আর তা হলো ইঁদুর। এই ইঁদুর সঙ্কট সমাধানের জন্যই সম্প্রতি এক উদ্যোগ নিয়েছিলেন নিউইয়র্ক কর্তৃপক্ষ । কিন্তু মজার ব্যাপার হলো শহরটিতে কোনো ইঁদুরই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কি করে পাবে বলুন, পৃথিবীর বেশ কিছু স্থানের লোকজন যে এখনো ইঁদুর ধরে ধরে খায়। তাদের কাছে ইঁদুরের তৈরি পদগুলোই হচ্ছে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার। আর এমনই এক আদিবাসী গোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া গেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা হচ্ছে ‘আদি’। প্রতি বছরের সাত মার্চ এই আদিবাসীরা উনিং-আরাণ নামে একটি ব্যতিক্রমী উৎসব পালন করে থাকে। এ জাতীয় উৎসব অন্যান্য আদিবাসীদের মধ্যে সাধারণত: দেখা যায় না। আর সেই উৎসবের মজাদার পদ হচ্ছে ঈঁদুরের ঝোল বা ‘ব্লু বুলাক অয়িং’। ইঁদুরের পাকস্থলী, অন্ত্র, যকৃত, পুরুষাঙ্গ , ভ্রূণ, লেজ, ডিম ইত্যাদির সঙ্গে লবণ, কাঁচা মরিচ ও আদা একসঙ্গে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় ওই ঝোল।
শুধু ইঁদুর নয়, তীক্ষ্ম দাঁতওয়ালা সবরকম প্রাণিই এ সম্প্রদায়ের কাছে সমাদৃত। তা সে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকা ইঁদুর কিংবা বনের জন্তু জানোয়ারই হইক না কেন। তবে ইঁদুরের পা ও লেজটিই তাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এ কথা জানালেন ফিনল্যান্ডের উলু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভিক্টর বেনো মেয়ার রোচো। সম্প্রতি আদিদের ওপর চালানো এক গবেষণার সময় এ গোত্রের কয়েকজন সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পেরেছেন, যে কোনো দাঁতাল প্রাণির মাংসই তারা খায়। তবে উৎসবে তাদের ইঁদুর চাই-ই-চাই। নইলে তাদেরেউৎসবের সব আনন্দই মাটি। গবেষক ভিক্টরকে তারা জানিয়েছে-পার্টি, উৎসব, অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে যে কোনো শুভ কাজেই তাদের ইঁদুর লাগে। কোনো আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে গেলেও তারা ফল ফলান্তির মত হাতে করে ইঁদুর নিয়ে যায়।
আদিদের জন্য ইঁদুর কেবল একটি মুখরোচক খাবার নয়, তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতেও বিশাল ভূমিকা রয়েছে এই প্রাণিটির। ধরুন, বিয়ের পর কোনো নববধূ প্রথমবারের মত শ্বশুড়বাড়িতে গেল। এসময় ইঁদুর দেখলে তার স্বামীর বাড়ির লোকজন ধরে নেবে, এই বৌ খুব পয়পন্ত এবং সে তাদের সংসাদের জন্য সুখ স্বচ্ছন্দ বয়ে আনবে। এ প্রসঙ্গে আরো একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন গবেষক ভিক্টর। তার ভাষায়, ‘উনিং-আরাণ উৎসবের সকালে বাচ্চাদের দুটি করে মরা ইঁদুর উপহার দেয়া হয়েছিল। এটি পেয়ে তারা এমন খুশি হয়েছিল যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। ক্রিসমাসের দিন সকালে খেলনা উপহার পেয়ে আমাদের দেশের শিশুরাও খুশি হয়। কিন্তু ইঁদুর পেয়ে আদি শিশুদের খুশি ছিল তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি।’
রোচে আরো জানান, তিনি আদি সম্প্রদায়ের গ্রামটির আশপাশের জঙ্গলে প্রচুর পরিমাণ হরিণ, ছাগল আর মহিষ দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু ওই আদিবাসীরা দাঁতাল প্রাণিদের মাংসকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাদের কাছে ‘ইঁদুরের চেয়ে মজাদার আর কিছুই হতে পারে না।’ তাদের ওই ইঁদুর উৎসবে যোগ দেয়ার পর নিরামিষাশী মেয়ার রোচো নিজেও তা স্বীকার করেছেন।
ইঁদুর খাওয়ার এই প্রবনতা শুধু মাত্র ভারতের এই আদিবাসীদের মধ্যেই যে রয়েছে, তা কিন্তু নয়। পৃথিবীর আরো অনেক দেশের আদিবাসীরাই ইঁদুর খায়। ব্রিটিশ টিভি উপস্থাপক স্টেফান গেটস বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সময় এ রকম বেশ কিছু উপজাতির দেখা পেয়েছেন যারা অপ্রচলিত খাবারে অভ্যস্ত। তিনি ক্যামেরুনের ইয়াউন্দে শহরের বাইরে ছোট একটি ইঁদুরের খামার দেখতে পেয়েছিলেন যাদের আকার ছোট ছোট কুকুরের মতই বড়। সেখানকার লোকজন গরু ছাগলের মত ইঁদুর পোষে। তাই মুরগি বা শাকসব্জির চাইতেও সেখানে বেশি দামে বিকোয় ইঁদুর। তবে গেটস মনে করছেন খাওয়ার জন্য ছোট ইঁদুরই সবচেয়ে ভালো। এদের স্বাদ অনেকটা কচি মুরগি বা কোয়েল পাখির মত। লোমসহ একটি আস্ত ইঁদুরের রোস্ট নাকি খেতে নাকি দারুন মজা!
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ইঁদুর ভক্ষন কোনো নতুন বিষয় নয়-গত কয়েক’শ শতাব্দি আগের মানুষের মধ্যেও এই খাদ্যাভ্যাস ছিল। নাভারাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ লিঙ্কন জানান, চীনে ট্যাং বংশের শাসনামলে (৬১৮-৯০৭ সাল) সে দেশের মানুষ ইঁদুর খেত। তারা একে বলত, ‘গৃহপালিত হরিণ ’। ট্যাং রাজাদের অতি প্রিয় ছিল মধু ও সদ্যজাত ইঁদুরের মিশেলে তৈরি একটি খাবার।
দুই বছর আগে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পলিনেসিয়ানস এবং নিউজিল্যান্ডের মাওরি জাতি ইঁদুর খেত বলে জানিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্রালয়ের গবেষক জিম উইলিয়ামস। এছাড়া ভারতের বিহার রাজ্যের দালিত সম্প্রদায়ের নিম্নমানের হিন্দুরাও ইঁদুর খেয়ে থাকে। আর এজন্য সেখানকার স্থানীয়রা তাদের ‘ইঁদুরখেকো’ বলে ডাকে।
মন্তব্য চালু নেই