প্রবাস জীবনের কথা
যে বাস্তব গল্পটি আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে
গত ঈদুল আজহার দুই সপ্তাহ আগের হিসাব অনুযায়ী ২৬ দিনে ১০৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই রেমিট্যান্সের অপর পিঠে কত গোপন হৃদয়ক্ষরণ, নির্ঘুম রাত, দীর্ঘশ্বাস, ঘামঝরা দুর্বিষহ কষ্ট জড়িয়ে, তা কেউ জানে না। কেউ না। জানা হয় না কারও। পরিবারের এক মুঠো সুখের পেছনের গল্প, গল্পই থেকে যায়। যে গল্পের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই।
অল্পবয়সী ছেলেটি ডিভি লটারি পেয়ে আমেরিকায় আসে। দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা সূত্রে আমার বাসায় ওঠে। খুব ভোরে উঠে কাজে যায়, কদিন আগেও মায়ের গভীর আদরের গণ্ডির ভেতরে থাকা ছেলেটি। কাজ থেকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে আমাদের ড্রইংরুমের সোফায়। রাত গভীরে তার গোঙানির শব্দ ভেসে আসে! হঠাৎ হাড়ভাঙা খাটুনিতে প্রচণ্ড জ্বর আর ব্যথার গোঙানি! সকালে আমি ওষুধ দিই। সে খায়। সুস্থ হয়ে আবার কাজে নেমে পড়ে। এভাবে প্রায় এক বছর আমাদের বাসায় ছিল সে।
আয়ের পুরোটাই দেশে পাঠাতে লাগল। উপরন্তু ধারদেনা করেও পাঠাচ্ছিল, যদিও তার পরিবার মোটামুটি সচ্ছল।
এক বছর বাদে আমি দেশে যাই। পরিবারটি সীমাহীন কৃতজ্ঞতায় নিমন্ত্রণ করে। আমি যাই। একপর্যায়ে জানলাম, তাদের বাসার টিভি, ফার্নিচার সব নতুন কেনা হচ্ছে। চারদিকে চোখ বুলালাম। বললাম, ‘এগুলোই তো অনেক সুন্দর, বদলাচ্ছেন কেন?’ ছেলেটির মা বললেন, ‘ছেলে টাকা পাঠাচ্ছে নিয়মিত, তাই এ রদবদল।’ ছোট ভাইগুলো ও মায়ের আবদার, সব মিলে সে এক হুলুস্থুল অবস্থা পরিবারটিতে।
এলোমেলো ভাবনা আর হৃদয় বিদীর্ণ করা দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরি। ছেলেটির প্রতিদিনকার কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময়কার করুণ, মায়াময়, বিষাদমাখা মুখখানা ভেসে ওঠে। গোঙানির সেই শব্দ কর্ণকুহরে সুইয়ের মতো বিঁধে, ঘুমাতে দেয় না আমায়। কুরে কুরে খায় একরাশ কষ্ট!
অবচেতন মনে ভাবি, আমার কেন এমন লাগছে! মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হয়ে যাচ্ছে না? নিজেকে নিজেই প্রবোধ দিই। অনেক বছর আগে দেশ ছেড়ে আসার সময় ছেলেটিকে কত ছোট দেখেছি! এখন আমার ছেলেটি যতটুকু, ঠিক ততটুকু!
মনে পড়ে, প্রথম এ দেশে এসে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলাম অস্থায়ীভাবে। বাড়তি ঘর না থাকায় আমি ঘুমাই ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে, সবাই ঘুমিয়ে গেলে। আবার সবাই ওঠার আগেই উঠে পড়ি বিছানাপত্র গুছিয়ে৷ যাতে পরিবারটির কোনো সমস্যা না হয় কিংবা আমায় অনাবশ্যক ঝামেলা মনে না করে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই এর ব্যতিক্রম হয়ে যেত। অনেক রাত অবধি গৃহকত্রীর সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ করলে খুব ভোরে কেমন করে উঠি! একদিন তিনি রেগে গেলেন। বললেন, ‘এভাবে ঘুমিয়ে থাকলে তো সমস্যা।’ অসহায় আমি সারাদিন-রাত লজ্জায় হেঁট হয়ে থাকি। অনুতাপে নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করি…কেন আজ ঘুম ভাঙতে বেলা হয়ে গেল! নতুন জায়গা, নতুন মানুষজন…যেন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়া! প্রতিটি মুহূর্তই চৈত্রের খরার মতোই নিঃশব্দে পোড়ায় আমায়! প্রচণ্ড গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার, তবুও ফ্যান কিংবা এসি টাচ করি না সংকোচে। কিন্তু আচমকা এক সন্ধ্যায় গৃহকত্রী রেগে গেলেন। এসি চালু কেন! আমি রাজ্যের বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। যদিও আমি তা করিনি, তবুও লজ্জায় সংকোচে আড়ষ্ট হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে থাকি।
অনেক বছর বাদে, এখন কাছের-দূরের আত্মীয়-অনাত্মীয় যাঁরা স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশে এদেশে আসেন, তারা স্বল্প সময় আমাদের বাসায় আশ্রয় নেন। মোটামুটি চলার মতো একটি কাজ পেলে বাসা ঠিক করে চলেও যান। ঘরের সংকটের কারণে, সেই স্বল্প সময়ে আমাদের ড্রয়িংরুমটিই তাঁদের একমাত্র ভরসা। খুব ভোরে আলো না জ্বেলে, আধো অন্ধকারে ছেলেকে খাইয়ে, রেডি করে স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে যাই সন্তর্পণে। ফিরে এসে নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করি, তাঁদের যেন ঘুম ভেঙে না যায়। এসি, ফ্যান কিংবা হিটার ঠিকঠাকভাবে চলছে কি না, দেখি। কোনো কারণে কেউ সংকোচ বোধ করছে কি না…লজ্জিত হচ্ছে কি না, ভাবনায় থাকি।
‘আমি যে তাহাদের মাঝে আমারেই খুঁজি, কারো জন্যে কিছু করবার সুযোগ বারেবারে আসে না, এটা আমরা কজন বুঝি ?’
এই যে অল্পবয়সী ছেলেটি পড়াশোনা শেষ করল না। অসময়ে সব আনন্দ বিসর্জন দিয়ে জীবনসংগ্রামে লেগে গেল৷ পরিবার থেকে ছিটকে গেল দূরে, হাজার মাইল দূরে। কোনো কিছুর বিনিময়েই কি আর সেসব ফিরে পাবে?
যে কারণে এত কথা, গত ঈদুল আজহার দুই সপ্তাহ আগের হিসাব অনুযায়ী ২৬ দিনে ১০৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই রেমিট্যান্সের অপর পিঠে কত গোপন হৃদয়ক্ষরণ, নির্ঘুম রাত, দীর্ঘশ্বাস, ঘামঝরা দুর্বিষহ কষ্ট জড়িয়ে, তা কেউ জানে না। কেউ না। জানা হয় না কারও। পরিবারের এক মুঠো সুখের পেছনের গল্প, গল্পই থেকে যায়। যে গল্পের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই।
রিমি রুম্মান চৌধুরী
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
মন্তব্য চালু নেই