যেসব কারণে ইইউ ছাড়ার পক্ষে রায় দিল ব্রিটিশরা

ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে গেল এর অন্যতম শক্তিশালী সদস্য দেশ যুক্তরাজ্য। ইইউতে ব্রিটেন থাকবে কি না- এ নিয়ে বিতর্ক চলছিল অনেক দিন ধরেই। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার (২৪ জুন) এ বিষয়ে এক গণভোটে ইইউ ছাড়ার পক্ষেই রায় দিল ব্রিটিশরা।

ইইউতে থাকা, না থাকা নিয়ে দুইভাগে বিভক্ত ছিল ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরাও। দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টি ইইউতে থাকার পক্ষেই ছিল। দলের পক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনও। তবে কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। ইতিমধ্যে পদত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। কোন কারণে জিতে গেল ইইউ ছাড়ার পক্ষের দল- এ নিয়ে তুলে ধরা হলো একটি বিশ্লেষণ:

১. অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা: ইইউ ছাড়লে ব্রিটিশরা দিন দিন গরিব হয়ে যাবে- এমন প্রচারণায় আগে থেকেই কানভারী করে রাখা হয়েছিল জনগণের। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ছাড়াও সিবিআই, ওইসিডি এবং আইএফস’র মতো সংগঠনগুলো এবং বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ একথাও বলেছেন, ইইউর বাইরে থাকলে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হবে, বেকারত্ব বেড়ে যাবে, পাউন্ডের পতন ঘটবে এবং ব্রিটেনের ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত এ নিয়ে কথা বলেছেন। ইইউ ছাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সতর্ক করেছিলেন তিনি। শীর্ষ ইইউ কর্মকর্তা ডোনাল্ড টাস্ক পশ্চিমাদের রাজনৈতিক সভ্যতার পতনের কথাও শুনিয়েছিলেন।

এই সব কিছুর পরেও ব্রিটেনের জনগণ ইইউ ছাড়ার পক্ষেই রায় দিয়েছে। কারো পরামর্শই শোনেনি ব্রিটিশরা। এটা ছিল প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের একটি বিদ্রোহ। যুক্তরাজ্যের বেশিরভাগ মানুষই মনে করেছে, ইইউর সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচ দশক থেকে পিছিয়ে পড়েছে তারা। এছাড়া আর্থিক সুবিধাও ছিল তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

২. স্বাস্থ্যখাতের ব্যয়: ইইউ ছাড়লে ব্রিটেনের বেঁচে যাওয়া খরচ থেকে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস) খাতে প্রতি সপ্তাহে অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড- এমন প্রচারণাও প্রভাবিত করেছে ব্রিটিশদের। এটা একটা সার্বজনীন রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন বয়স এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির লোকেরা এতে আকৃষ্ট হয়েছে।

বেশিরভাগ ব্রিটিশ মনে করে ইইউতে তাদের যে পরিমাণ খরচ হয় তা যুক্তরাজ্যের আভ্যন্তরীণ কাজে খরচ করাটাই বরং বেশি ফলপ্রসূ হবে। ইইউ ছাড়ার পক্ষে এই প্রচারণাটি বেশ শক্তিশালী প্রচারণা হিসেবে কাজ করেছে।

৩. অভিবাসন ইস্যুতে নাইজেল ফ্যারাগের প্রচারণা: ইইউ ছাড়ার পক্ষে জনগণকে ভোট দিতে অভিবাসন ইস্যুতে নাইজেল ফ্যারাগের প্রচারণা বেশ কাজে লেগেছে। এটা নিম্ন আয়ের ভোটারদের বেশি প্রভাবিত করেছে। ফ্যারাগে আগে থেকেই বলে এসেছেন, সরকারি লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, ব্রিটেনে অভিবাসীর সংখ্যা এক লাখের নিচে রাখতে হলে ইইউ ছাড়তে হবে। জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্নটিও জড়িত ছিল এখানে।

এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, গত ১০ বছরে যুক্তরাজ্যে অভিবাসীর সংখ্যা, সমাজে তাদের প্রভাব এবং এতে আগামী ২০ বছরে যা ঘটতে পারে- এ নিয়ে ব্রিটিশদের উদ্বেগের চেয়ে প্রকৃত অবস্থা আরো কঠিন ছিল।

৪. প্রধানমন্ত্রীর কথা শোনেনি জনগণ: গত ১০ বছরে দুটি জাতীয় নির্বাচন এবং দুটি রেফারেন্ডামে জিতে গেলেও এবার আর ভাগ্য সহায়ক ছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের। ইইউতে থাকার প্রচারণার মধ্যমণি ছিলেন তিনি। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও নিয়েছেন ক্যামেরন। নিজের বিভিন্ন পদক্ষেপ সত্ত্বেও দলের ভেতরেও ইইউতে থাকা, না থাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল।

এ কারণেই হয়তো বেশিরভাগ ভোটারকে নিজের দিকে টানতে পারেননি ক্যামেরন। এটা তার ব্যর্থতাই ছিল। প্রচারণার মাধ্যমে পুরো দেশকে এক কাতারে আনতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগের ঘোষণাও ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছেন তিনি। আগামী অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাবেন তিনি।

৫. ভোটারদের পক্ষে টানতে লেবার পার্টির ব্যর্থতা: গণভোটের রায়কে নিজেদের পক্ষে নিতে ইইউতে থাকার সমর্থক শিবিরের দরকার ছিল লেবার পার্টির ভোটরদের। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে তারা নিজেদের ভোটরদের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ লেবার পার্টির ৯০ ভাগ সংসদ সদস্যই ইইউতে থাকার পক্ষে ছিলেন। এমনকি প্রচারণার সময় যখন তারা এ নিয়ে সমস্যা অনুভব করেছেন তখনও তারা কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

গর্ডন ব্রাউন এবং সাদিক খানের মতো হেভিওয়েট লোকজন ইইউতে থাকার পক্ষে থাকলেও তারা নিজেদের ভোটরদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ব্যাপারে এক ধরনের সামগ্রিক ব্যর্থতা থাকলেও সমালোচনার লক্ষ্য হয়েছেন শুধু লেবার পার্টির প্রধান অ্যালান জনসন এবং জেরেমি করবিন।

৬. বরিস জনসন ও মাইকেল গভ ইস্যু: ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার একটা অংশ আগে থেকেই ইইউ ছাড়ার পক্ষে ছিল। তবে সেই দলে যখন বরিস জনসন এবং মাইকেল গভের মতো হেভিওয়েটরা যুক্ত হয় তখন তা ভিন্ন দিকে মোড় নিতে বাধ্য। একদিকে বিচারমন্ত্রী মাইকেল গভ ইইউ ছাড়ার পক্ষে বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণা এবং কৌশল তুলে ধরছিলেন। অপরদিকে লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন এ নিয়ে পায়ে হেঁটে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেলেন।

স্কাই নিউজ এবং বিবিসির মাধ্যমে বারবার জনগণের মুখোমুখি হয়েছেন গভ। ইইউ ছাড়ার পক্ষের লোকজনকে এক প্লাটফর্মে আনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আর বরিস জনসনের ভূমিকা ছিল একজন ‘ফুট সোলজার’র মতো।

৭. বয়োজ্যেষ্ঠ ভোটারদের ভূমিকা: যুক্তরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বয়োজ্যেষ্ঠ ভোটাররা তাদের ভোট দিয়েছেন ইইউতে থাকার পক্ষে। যুক্তরাজ্যের ২০১৫ সালের নির্বাচনেও দেখা যায়, ৬৫ বা বেশি বয়সী ৭৮ ভাগ লোকই তখন ভোট দিয়েছেন। বিপরীতে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ভোটররা ভোট দিয়েছে ৪৩ ভাগ। আর ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীরা ভোট দিয়েছে ৫৪ ভাগ।

জরিপে দেখা যায়, ৫৫ বছরের বেশি বয়সীরা বেশিরভাগই ব্রিটেনের ইইউ ছাড়ার পক্ষে ছিলেন। রেফারেন্ডামে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রতি পাঁচজনে দুইজন ভোটারই ছিলেন ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। এটাই ইইউ ছাড়ার পক্ষে বেশি ভোট পড়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

৮. ইউরোপ-যুক্তরাজ্য সম্পর্ক: ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক ছিল না। ছিল না স্থিতিশীলও। এর আগেও ইউরোপীয় কমিউনিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় সংস্থাটিতে যোগ দিতে কয়েক বছর সময় নিয়েছিল যুক্তরাজ্য। এমনকি ১৯৭৫ সালে যুক্তরাজ্য যখন যোগ দেয় সামান্য কিছু অর্থনৈতিক সুবিধার কথা ভেবেই অনেকে এটা সমর্থন দেয়। অনেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে সমর্থন দিয়েছিল।

এদের একটি বড় অংশই তাদের মন পরিবর্তন করে ফেলেছেন। ইউরোপের অনেক রাজনীতিবিদ এবং গণমাধ্যমই যুক্তরাজ্যের ইইউতে থাকা সমর্থন করেনি। তরুণদের ইইউতে থাকার পক্ষে মনে হলেও শেষ পর্যন্ত তারা জিততে পারেনি। সব মিলিয়ে, নিজেদের জাতীয় পরিচয় এবং এর সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ইইউ ছাড়ার পক্ষে রায় দিয়েছে বেশিরভাগ ব্রিটিশ।



মন্তব্য চালু নেই