যেভাবে ৭২ ঘণ্টায় মারা গেল ৮ হাজার মানুষ
ভারতের ভূপালে ২০০৯ সালের ২ ডিসেম্বর দিবাগত রাত- অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহরে মার্কিন মালিকানাধীন ইউনিয়ন কার্বাইড কীটনাশক কারখানার ভূর্গভস্থ মজুত ট্যাংক ফেটে গেলে সেখান থেকে বের হতে শুরু করে ৪০ টন বিষাক্ত গ্যাস মিথাইল আইসোসায়ানেট।
ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াই পি গোখেল জানান, অতিরিক্ত চাপের মুখে ট্যাংকের একটি ভালব ভেঙে গেলে ভেতর থেকে গ্যাস বের হতে শুরু করে।
নয় লাখের বাসিন্দার ঘনবসতির শহর ভূপালের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে মারণাত্মক রাসয়নিকের মেঘ।
প্রায় ৫ লাখ মানুষ ওই গ্যাসের কবলে পড়ে। প্রাণ হারায় কয়েক হাজার মানুষ। গ্যাসের ওই মেঘ ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রেখে যায় মারাত্মক রোগব্যাধির অভিশাপ।
কী ঘটেছিল তেসরা ডিসেম্বর দুর্ঘটনা কালোরাতে ?
ভূপালের বেশিরভাগ বাসিন্দা গভীর ঘুমে। ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানার পাঁচিলের বাইরে চালাঘরগুলোর বাসিন্দাদের জন্যও সে রাতটা ছিল আর পাঁচটা রাতের মতোই। কারখানার গায়ে লাগোয়া বস্তিগুলোতে বাস বহু মানুষের। কাছেই ভূপাল শহরের পুরনো এলাকাতেও থাকে হাজার হাজার মানুষ।
কারখানাটি তৈরি হয়েছে ১৯৬৯ সালে- চরম বিপদজনক রাসয়নিক মিথাইল আইসোসায়ানেট ব্যবহার করে কীটনাশক উৎপাদন করছে তারা।
রাত প্রায় ১টা
এই সময়ই কারখানা এলাকায় কিছু বস্তিবাসীর প্রথম নাকে আসে একটা দুর্গন্ধ- তাদের চোখ জ্বলতে শুরু করে। কেউ কেউ বলেন ‘মনে হচ্ছে ধারেকাছে কেউ মরিচ পোড়াচ্ছে।’
অবস্থা আরো খারাপের দিকে মোড় নেয়- গন্ধ আরো তীব্র হয়ে ওঠে। মানুষ অল্পক্ষণের মধ্যেই নিঃশ্বাস নিতে কষ্টের কথা বলতে শুরু করে। অনেকে বমি করতে শুরু করে।
শহর ও শহরতলিতে ভীতি ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করে।
‘দেখা যায় মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে- তাদের মুখ দিয়ে ফেনা বেরচ্ছে- অনেকে চোখ জ্বালার কারণে চোখ খোলা রাখতে পারছে না।’
হাজেরা বাই পাঁচ বছর আগে বিবিসিকে বলেন, সেই ভয়ঙ্কর রাতের স্মৃতি তিনি কখনো ভুলবেন না- ‘মাঝরাত নাগাদ আমার ঘুম ভেঙে গেল- দেখলাম মানুষজন রাস্তায় নেমে এসেছে- যে কাপড়ে ঘুমোচ্ছিল সেই কাপড়েই তারা বেরিয়ে এসেছে- কারো কারো গায়ে শুধু অর্ন্তবাস।’
ভয়ে লোকজন এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে আর তা করতে গিয়ে আরো গ্যাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে টানছে।
‘বিষাক্ত ওই গ্যাস ছিল বাতাসের থেকে ভারী- কাজেই মজুত ট্যাংক থেকে বেরন গ্যাসে ঘন মেঘের আস্তরণ তৈরি হয়,’ ২০০৯ সালে ওই কালোরাত্রির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে জানান সেসময় ভূপালের পুলিশ প্রধান স্বরাজ পুরি- ‘ওই গ্যাসের মেঘ কারখানার চারপাশের বাতাসে ভর করে নিঃশব্দে এগিয়ে চলে।’
ভোররাত ২.৩০টা
কারখানায় বিপদসংকেত সাইরেন বেজে ওঠে। লোকে চিৎকার করতে থাকে, ‘কারখানা থেকে গ্যাস লিক করছে।’
‘‘আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে- চোখ জ্বলতে থাকে। ঘন গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে তখন রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না, সাইরেনের শব্দে কান ফেটে যাচ্ছে- কোনদিকে দৌড়াব কিছুই আমরা বুঝে উঠতে পারছি না- সকলেই উদভ্রান্ত।’ ১৯৮৪-র ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর বিবিসিকে বলেন এলাকার বাসিন্দা আহমেদ খান।
খান জানান, মানুষ তখন ভয়ে দিশেহারা হয়ে ছুটছে।
‘মা জানে না তার সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, সন্তান জানে না তার মাকে সে হারিয়েছে। পুরুষরা জানে না তাদের গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’
ওই সময় বিবিসির সংবাদদাতা মার্ক টালি তখন খবর দিচ্ছেন ‘শহরের প্রধান হাসপাতাল মানুষের ভিড় উপছে পড়ছে, ক্রমাগত গ্যাস আক্রান্ত মানুষকে নিয়ে আসা হচ্ছে।’
‘রাস্তার ওপর হাজার হাজার মরা বিড়াল, কুকুর, গরু এবং পাখির স্তুপ- শহরের মর্গ ভরে উঠছে মৃতদের ভিড়ে।’
ভোর ৪টা
ভূপালের সাবেক পুলিশ প্রধান পুরি বিবিসিকে বলেন, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যয়ের ব্যাপকতা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা তারা পান।
‘আমার ও আমার কর্মচারীদের ওপর মৃতদেহ সরানোর দায়িত্ব পড়ে। তখন বুঝতে পারি কী অবস্থা। চর্তুদিকে শুধু লাশ আর লাশ।’
‘আমার মনে হচ্ছিল- হে ঈশ্বর- এ কী ঘটল? কী হচ্ছে- আমরা স্থবির হয়ে গিয়েছিলাম- বুঝতে পারছিলাম না কী করব- কিভাবে সব সামাল দেব?’
মৃতের সংখ্যা তখন ক্রমশই বাড়ছে। ৭২ ঘন্টায় ৮,০০০-এর বেশি মানুষ মারা গেছে।
এর পরের কয়েক মাসে আরো কয়েক হাজার প্রাণহানি ঘটেছে।
সরকার দাবি করেছে, বিষাক্ত গ্যাসে মোট ৫,২৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে এই দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বিশ হাজারের বেশি।
পরিবেশবাদীরা বলে আসছেন ওই কারখানা থেকে নির্গত বিষ এখনো এলাকার মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিকে বিষাক্ত করছে। কিন্তু রাজ্য সরকার এই দাবি মানতে নারাজ- তাদের মতে কারখানা এলাকার পানি নিরাপদ।
ভূপাল বিপর্যয় নিয়ে আন্দোলনকারী এবং ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে কাজ করছেন যারা তারা দাবি করছেন ওই ঘটনার শিকার দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সার, অন্ধত্ব, যকৃৎ ও কিডনির নানা অসুখে ভুগছেন।
তাদের প্রকাশিত নানা প্রতিবেদনে তারা তুলে ধরেছেন ভূপালের শিশুরা নানাধরনের জন্মগত পঙ্গুত্বের শিকার- ওই বিপর্যয়ের পর জন্ম নেয়া শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়নি- তাদের অনেকে ক্যান্সার ও নানা জটিল রোগে ভুগছে।
কারখানা এখন পরিত্যক্ত
ইউনিয়ন কার্বাইডের কারখানা এখন পরিত্যক্ত। মধ্যপ্রদেশের সরকার ১৯৯৮ সালে এই কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
ইউনিয়ন কার্বাইডের কোনো শীর্ষ কর্তাব্যক্তিকে ভূপালের ওই ঘটনার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় তোলা যায়নি।
সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান, ওয়ারেন অ্যান্ডারসন, দুর্ঘটনার কয়েক দিন পরই কারখানা দেখতে ভূপালে গেলে তাকে ভারতীয় পুলিশ গ্রেপ্তার করে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি জামিন পেয়ে যান, এবং তড়িঘড়ি ভারত ত্যাগ করেন।
তাকে সরকারিভাবে ‘পলাতক’ ঘোষণা করা হয়। তবে ভারত সরকার তাকে বিচারের জন্য ভারতে পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সেভাবে কখনো জোরেসোরে চাপ দেয়নি। অ্যান্ডারসন এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে মারা যান।
ভূপাল দুর্ঘটনায় জীবিতদের আইনগত প্রতিনিধি হিসেবে ভারত সরকার প্রথমে ৩.৩ বিলিয়ন ক্ষতিপূরণের আবেদন করেছিল। কিন্তু আদালতের বাইরে এক সমঝোতার মাধ্যমে ইউনিয়ন কার্বাইড ১৯৮৯ সালে ৪৭ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়মুক্ত হয়।
কিন্তু আন্দোলনকারীরা সবসময়ই যুক্তি দেখিয়েছে ওই ক্ষতিপূরণ কখনই যথেষ্ট ছিল না। সূত্র: বিবিসি।
মন্তব্য চালু নেই