যেভাবে একজন মোদী…

২০০১ সালে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েই নিজের ২৮ জন শিক্ষককে ডেকে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন মোদী। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই অভিনয় ও বিতর্কে দারুণ আগ্রহ ছিল তার।

ভাডনগরের বি এন হাইস্কুলের শিক্ষক, পি জি প্যাটেল ভারতীয় জনতা পার্টির সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে এমন মন্তব্যই করেছেন।

গর্বে ছাত্রের প্রশংসা করে বৃদ্ধ অধ্যাপক আরও বলেছেন, ‘ও এতদূর যাবে বুঝতে পারিনি। তবে ও যে এই ভাডনগরের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আটকে থাকবে না তা বেশ বুঝতে পারতাম।’

‘ভাডনগর’ নামটা শুনলেই প্রত্যেকেই বলে ওঠেন, ওটা মোদীর গ্রাম? মোদী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে এটি মেহসানা জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম ছিল। কিন্তু মুখ্য সচিব হওয়ার পরেই এক অভূতপূর্ণ উন্নতি দেখা গেছে এই ভাডনগরে। শহরে ঢোকার মুখেই অত্যাধুনিক রেঁস্তোরা, ব্যঙ্কোয়েট হল, সারি সারি দোকান, জমজমাট বাজার, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল। এসব থেকে কিছুটা মুখ লুকিয়ে ঝোপ জঙ্গলে প্রায় আড়াল হয়ে গিয়েছে ভাডনগর রেল স্টেশনটা। স্টেশনে ঢোকার মুখেই, টিকিট ঘরের ঠিক উল্টো দিকেই তিন ফুট বাই চার ফুটের দোকানটা।

দামোদর দাসের ওই বন্ধ দোকানের চায়ের কেটলিই এখন নরেন্দ্র মোদীর গা থেকে কর্পোরেট তকমা মুছে ফেলে তাকে আম আদমি প্রমাণ করার প্রধান হাতিয়ার। দামোদর মোদীর দোকানের খোঁজ নিলেও এখন উৎসাহে ভিড় পড়ে যায় নানা বয়সের একগাদা লোকজনের। এই ভাডনগরের ছোট্ট চায়ের দোকান থেকেই গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী আর এখন ভারতের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী।

ফেলে আসা সময় অনেক কিছুই বদল এনেছে তার জীবনের। কিন্তু তার মধ্যে মোদীর শিক্ষকের মতো অনেকেই ভাডনগরে এখনও আছেন যারা মোদীর সঙ্গে কাটানো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।

যাদের মধ্যে অন্যতম ডাক্তার সুধীরভাই যোশী। স্কুলে প্রায় সাত বছর পাশাপাশি বসে ক্লাস করেছেন নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে। তিনি জানান, আহমেদাবাদ গেলে এখনও দেখা করে আসেন পুরনো বন্ধু এন ডি’র সঙ্গে।

তবে মোদীর নাম যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বারে বারে দাঙ্গাবাবু, দাঙ্গাবাজ বলে কটাক্ষ করেছেন প্রতিপক্ষরা, সেই ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলতেই চোখেমুখে অস্বস্তি ফুটে ওঠে সুধীরের।

মৃদুভাষী এ ডাক্তার জানিয়েছেন, ‘ছোট থেকেই ও খুব একরোখা, জেদি। তবে ওকে মুসলিম বিদ্বেষী বলা যায় না। ওর বাড়ি তো মুসলিম পাড়াতেই ছিল।’ ঠিক যেমনই ভূমিপুত্রের টানে কর্মভূমি ছেড়েছেন সহস্রাধিক গুজরাটি।

নরেন্দ্র মোদীকে দেশের মসনদে বসানোর উদ্দেশ্যে শেষ মুহূর্তের প্রচারে হাত মেলাতে চাকরি ছেড়ে, ব্যবসা লাটে তুলে দলে দলে বারাণসীতে ভিড় জমিয়ে ছিলেন সেই সমস্ত গুজরাটিরা। কিন্তু কিভাবে প্রচারে সাহায্য করেছিলেন তারা!

এক বেসরকারি সংস্থার প্রাক্তন কর্মী জেমিন পাঞ্চাল বলেন, ‘মোদীজি ও গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে বিরোধীদের অনেকাংশ যে ভুয়ো প্রচার চালাচ্ছে সে বিষয়ে মানুষকে সচেতন করব।’

গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রচারণা শুরু করলেও, ফেব্রুয়ারিতেই প্রথম ব্রিগেডের মাটিতে মোদী প্রচার শুরু করেন। দুই হাতে দুই লাড্ডু, কেন্দ্রের জন্য আমি কাজ করবো আর রাজ্যের জন্য দিদি কাজ করবেন। ঠিক এই তত্ত্বই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে তুলে ধরে ছিলেন মোদী। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়টিকে প্রশ্রয় দেননি। সেদিন ব্রিগেডে মানুষের ভিড় বেশি না থাকলেও মোদী মনোবল হারাননি। তিনি বারবার পশ্চিমবাংলায় এসেছেন ও ধীরে ধীরে তার জনপ্রিয়তা শিখর ছুঁয়ে গিয়েছে।

শিল্পানুরাগী মোদীর শিল্প মহলেও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল। লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাসে বৃহত্তম জনসংযোগের রেকর্ড গড়েছেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর প্রচার।

লোকসভা নির্বাচন ২০১৪-এর তার মোট যাত্রাপথ ৩ লাখ কিলোমিটার (৩০০,০০০ কি.মি)। ২৫টি রাজ্য ঘুরে ৪৩৭টি জনসভা করেছেন তিনি।

অত্যাধুনিক থ্রিডি শোভাযাত্রার সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৩৫০। বিজেপির এই পোস্টার বয়ের গা থেকে কর্পোরেট তকমা মুছে ফেলে তাকে আম আদমি প্রমাণ প্রধান হাতিয়ার চায় পে চর্চার সংখ্যা ৪০০টি। এছাড়াও ভদোদরা, বারাণসীর রোড-শো মিলিয়ে মোট ভারত বিজয় মিছিল করেছেন ১৯৬টি।

সব মিলিয়ে জনসভা, অনুষ্ঠান ও রোড শো-এর সংখ্যা ৫ হাজার ৮২৭টি। মোদীর লহরে এখন দেখার আর কি রেকর্ড গড়তে চলেছেন তিনি, কোনো সাধারণ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ব্যবধানে জয়ের প্রথমে আছেন সিপিএম-এর অনিল বসু, ২০০৪ বিধানসভা নির্বাচনে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৫০২ ভোটে জয়ী হয়ে ছিলেন তিনি।

পাশাপাশি গুজরাটে সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়ের প্রথমেই যার নাম তিনি হলেন বল্লভ কাঠিরিয়া। ১৯৯৮ সালে রাজকোট আসনে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ১৮৭ ভোটে জয়ী। এই রেকর্ডে হাত ছোঁয়াতে পারেননি আদভানি-বাজপেয়ীর মতো মহীরূহরাও।

আর এই মোদী হাওয়াই হয়তো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই হয়তো মোদীর প্রধানমন্ত্রী হলে চেয়ার বেঁচে দেবেন এমন মন্তব্যও করেছিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়।

এতদিন যাকে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করে বলা হতো চির কুমার মোদী।

বিজেপির এই পোস্টার বয়ের কুমারত্ব যেদিন ঘুচলো, যেদিন মনোনয়নপত্রে নিজের স্ত্রীর নামের জায়গায় ভরে দিলেন যশোদাব্যনের নাম, ঠিক তখনই বিরোধীরা মোদী বিরোধী মূল হাতিয়ার বানিয়েছিলেন তার স্ত্রীকে।

বিরোধীরা বারবার বলেছিলেন যিনি নিজের স্ত্রীকে যোগ্য সম্মান দিতে পারেন না তিনি দেশ কি করে চালাবেন। কিন্তু বিরোধীদের এই দাওয়াইও অবশেষে কাজে লাগেনি। বাংলায় নিজের জায়গা বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী।

তিনি বারবার বাংলায় এসে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ ওনার কাছে তীর্থভূমির মতো। আর গণতন্ত্রের উৎসবের পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতের ভাবি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়তেও আগ্রহী। গুজরাটে শিল্পে উন্নয়ন করে গোটা বিশ্বের মধ্যে গুজরাটকে মডেল করে তুলেছেন। সে কারণে শিল্পানুরাগী হওয়ায় ভারত তথা গোটা বিশ্বের কাছে শিল্পের দিক থেকে উজ্জল ভাবমূর্তি রয়েছে তার। তাই মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে বিশ্বের নানান দেশের উন্মুক্ত বিনিয়োগ কেন্দ্র হতে চলেছে ভারতে।

দেশের জমিনীতি, শিল্পনীতির সুষ্ঠু সমাধান হতে চলেছে। যে কারণে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর নাম ঘোষণা হওয়ার পরই ভারতের অর্থনীতিও চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। এখন অপেক্ষা শুধু ১৬ মে’র।



মন্তব্য চালু নেই