যুক্তরাষ্ট্রসহ ১১ দেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব ক্ষুব্ধ ইসরায়েলের

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বন্ধের প্রস্তাব পাসের ঘটনায় এ ইস্যুতে ভোট দেওয়া দেশগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে ইসরায়েল। এরইমধ্যে এ ইস্যুতে ইসরায়েলকে সমর্থন না দেওয়ায় তেল আবিবে নিযুক্ত ১১টি দেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে ইসরায়েল।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইসরায়েলের অন্য যেসব দেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে সে দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, মিসর, উরুগুয়ে, স্পেন, ইউক্রেন ও নিউজিল্যান্ড।

শুক্রবারের ভোটাভুটিতে যুক্তরাষ্ট্র ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। ফলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বন্ধের প্রস্তাবটি প্রস্তাবটি ১৪-০ ভোটে পাস হয়। এ ঘটনায় রবিবার ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার বৈঠকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আবারও ওবামা প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করেছেন।

এ প্রস্তাব পাসের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বারাক ওবামা প্রশাসনকে অভিযুক্ত করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার ভাষায়, ‘আমাদের কাছে যেসব তথ্য রয়েছে সে অনুযায়ী আমাদের কোনও সন্দেহ নেই যে, ওবামা প্রশাসন এ প্রস্তাবের উদ্যোগ নিয়েছে, এর পেছনে দাঁড়িয়েছে, এর ভাষা ঠিক করে দিয়েছে এবং প্রস্তাবটি পাসের জন্য দাবি তুলেছে।

নেতানিয়াহু’র দাম্ভিক উচ্চারণ, ‘ইস্যুটি সমাধানের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ উপযুক্ত জায়গা নয়।’ তিনি জানিয়েছেন, এ প্রস্তাব পাসের জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা-না রাখার ব্যাপারেও ভাবছে ইসরায়েল।

শনিবার এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেন, ‘জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইসরায়েলি সহায়তা, ইসরায়েলে থাকা জাতিসংঘ প্রতিনিধিসহ ওই সংস্থার সঙ্গে আমাদের যাবতীয় সম্পর্ক এক মাসের মধ্যে পুনর্বিবেচনা করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি।’

শনিবারের সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের ৫ সংস্থাকে ইসরায়েলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন বলে আখ্যায়িত করেন নেতানিয়াহু। তিনি জানান, এরইমধ্যে ওই সংস্থাগুলোতে ৭৮ লাখ ডলারের তহবিল বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও তহবিল বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে।

এর আগে এ ঘটনায় প্রস্তাব উত্থাপনকারী সেনেগাল ও নিউজিল্যান্ড থেকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতদের দেশে ফেরার নির্দেশ দেয় তেল আবিব। নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাসের পর শনিবার এ সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু’র দফতর।

এরইমধ্যে সেনেগালকে দেওয়া ইসরায়েল সরকারের সব ধরনের সাহায্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন ক্ষুব্ধ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। সেনেগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পূর্বনির্ধারিত ইসরায়েল সফর বাতিলেরও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বন্ধের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল। এই প্রস্তাবের নিন্দা জানানো পাশাপাশি তারা জানিয়েছে, প্রস্তাবের কোনও শর্ত মানতে বাধ্য নয় ইসরায়েল।

২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ শুক্রবার ১৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি তুলে ধরা হয়। ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধের ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ‘১৯৬৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল যে বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে, তার কোনও আইনি ভিত্তি নাই।’ ভোটদানে থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। বাকি ১৪টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে তা পাস হয়।

প্রস্তাবটিকে আন্তর্জাতিক আইনের বিজয় এবং ইসরায়েলি চরমপন্থার প্রত্যাখান বলে উল্লেখ করেছে ফিলিস্তিন। আর ইসরায়েল বলছে, তারা এর তোয়াক্কা করে না। প্রস্তাবের কোনও শর্তই মানবেন না তারা।

এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘এমন এক অদ্ভুত প্রস্তাব যেন কোনও খারাপ প্রতিক্রিয়া না ফেলতে পারে, এ লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত ইসরায়েল।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘে পাশ হওয়া ওই লজ্জাজনক ইসরায়েল-বিরোধী প্রস্তাব ইসরায়েল প্রত্যাখ্যান করে। ইসরায়েল তা মানতে দায়বদ্ধ নয়। ইসরায়েলকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘে গড়ে ওঠা দলবাজি রুখতে ব্যর্থ হয়েছে ওবামা প্রশাসন। দৃশ্যপটের বাইরেই কেবল তারা সংঘাতে জড়ায়।’

সিরিয়া গৃহযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে নেতানিয়াহু বলেন, ‘একই সময়ে যখন সিরিয়ায় পাঁচ লাখ মানুষের হত্যা রুখতে নিরাপত্তা পরিষদ কিছুই করেনি, তখন মধ্যপ্রাচ্যে সত্যিকারের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা লজ্জাজনক দলবাজি করছে।’

জাতিসংঘে ইসরায়েলি দূত ড্যানি ড্যানন আল-জাজিরাকে বলেন, তাদের সরকার আশা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবে ভেটো দেবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নতুন মার্কিন প্রশাসন এবং জাতিসংঘের নতুর মহাসচিব এসে নতুন কিছু করবে।

এর আগে বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিসর একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে। তাতে দাবি জানানো হয়, পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণ জরুরি ভিত্তিতে ও পূর্ণাঙ্গভাবে বন্ধ করতে হবে। মিসরের ওই প্রস্তাবেও একইভাবে বলা হয়েছিল, ‘ইসরায়েলের ওইসব বসতির কোনও বৈধতা নেই। আর তা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’

নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় জাতিসংঘে এ নিয়ে ভোটাভুটির কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগে হঠাৎ মিসর প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভোটাভুটি স্থগিত করা হয়। পরে নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভেনেজুয়েলা, সেনেগালের পক্ষ থেকে একই প্রস্তাব তুলে ধরা হলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ঐতিহাসিক’ নীরবতায় তা পাস হয়।

এ প্রস্তাব পাসের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের প্রধান প্রতিনিধি ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আজ আন্তর্জাতিক আইনের বিজয়ী হওয়ার দিন। সুসভ্য ভাষা এবং সংকট নিরসন প্রক্রিয়ার জয়। এটি ইসরায়েলি চরমপস্থার সুস্পষ্ট প্রত্যাখ্যান।’ তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলকে বার্তা দিয়েছে, দখল কায়েমের মধ্য দিয়ে শান্তি আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। বরং শান্তি আনতে দরকার দখল বন্ধ করা, এবং ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী ইসরায়েল রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া।’

প্রসঙ্গত, ফিলিস্তিনিরা চায় পশ্চিম তীরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে এবং পূর্ব জেরুজালেমকে এর রাজধানী বানাতে। ১৯৬৭ সালের আরব যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে রেখেছে। পূর্ব জেরুজালেমকে নিজেদের অবিভাজ্য রাজধানী বলে দাবি করে থাকে ইসরায়েল। অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৬৭ সালের পর পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে শতাধিক বসতি স্থাপন করেছে ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এ বসতি স্থাপনকে অবৈধ বলে বিবেচনা করা হলেও ইসরায়েল তা মানতে চায় না। ১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বেশ কয়েক দফায় শান্তি আলোচনা হলেও তা ব্যর্থ হয়। সূত্র: বিবিসি, ফক্স নিউজ, আনাদোলু এজেন্সি, আল জাজিরা।



মন্তব্য চালু নেই