মৃত্যু নিয়ে যা লিখে গেছেন প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি

মৃত্যু কি পুরুষ না নারী?… আল্লাহই জানে। তবে প্রাচীন জাহেলি কবি তারাফা বিন আব্দ মনে করেন, মৃত্যু পুরুষ। আর ‘আধুনিক জাহেলি’ কবি নাযার কবানি বলেছেন : মৃত্যু নারী। কারণ এই ছিলানী ডাইনিটাই তার বুক থেকে তার ছেলে ‘তাওফীক’কে ছিনিয়ে নিয়েছে।

কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? মৃত্যু পুরুষ না নারী তা জেনে আমাদের লাভ কী? মৃত্যু তো পুরুষ হোক আর নারী হোক মৃত্যুই। না… ধারণাটা ঠিক নয়। অবশ্যই মৃত্যুর লিঙ্গ নির্ধারণ করতে হবে। মৃত্যু নারী না পুরুষ সেটা জানা দরকার। যদি সে পুরুষ হয় তাহলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সাথে লড়ে যেতে হবে। আর যদি ও নারী হয় তাহলে তার কোল-বন্দিত্ব মেনে নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। ভাষাগতভাবে মৃত্যু কিন্তু কখনো পুংলিঙ্গ কখনো স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

এ বিষয়ে আমার নিজেরও একটা মত আছে : মৃত্যুর সাথে লড়াইয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে মৃত্যু পুরুষ এবং সবসময় আক্রমণাত্মক, সে কখনো পরাজিত হলেও না রক্ষণাত্মক অবস্থান নেয় না। এবং মৃত্যু বেশ সাহসী এবং হিংস্র। তবে কখনো কখনো তাকে ভীরু ও প্রতারক হতেও দেখেছি এবং মানুষ যে মনে করে মৃত্যু অপরাজেয়, প্রতিটি আক্রমণে সফল, সেটা সঠিক নয়। মৃত্যু কোনো কোনো সময় ভীষণভাবে পরাজিতও হয়, লেজ তুলে রণক্ষেত্র ছেড়ে পালানোর মতো শোচনীয় অবস্থাতেও পড়ে।

কোনো বীরপুরুষের সাথে লড়াইয়ে, মল্লযুদ্ধে মৃত্যু হেরে গেছে, আহত-রক্তাক্ত হয়ে কুরুক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেছে এমন ঘটনা খুব বিরল নয়। কিন্তু মৃত্যু মার খেয়ে, আহত হয়ে একেবারে ধরাশায়ী হয়ে গেছে, আত্মসমর্পণ করেছে বা প্রতিপক্ষের হাতে বন্দী হয়েছে এমনটা কখনো ঘটেনি। এটাই হচ্ছে মৃত্যুর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক। এর ফলেই মৃত্যু সবসময় জীবনের বিরুদ্ধে জিতে যাচ্ছে।

মৃত্যুর রণকৌশল সত্যিই বিরল। মৃত্যু লড়াই করে সীমাহীন ধৈর্য এবং জয়ের ব্যাপারে তার প্রতিপক্ষ যত পরাক্রমশালীই হোক না কেন সম্পূর্ণ আস্থা নিয়ে। এমনকি সে যখন মাঝে মাঝে হারতে থাকে বা মারাত্মকভাবে আহত হয় তখনো তার সেই আস্থায় বিন্দুমাত্র চির ধরে না এবং মৃত্যুঞ্জয়ী বিভ্রান্ত বীরদের বিজয় উৎসবের দূরাগত সঙ্গীত-ধ্বনি তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না, তার মধ্যে হাতাশা জাগায় না। সে বরং নতুন উদ্যমে আবার আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়।

মৃত্যুর এই সর্বজয়ী শক্তির উৎস এই নয় যে, তার সব আক্রমণ সফল এবং সব আঘাত অব্যর্থ হয়ে থাকে। মৃত্যুর তীরগুলো বরং অধিকাংশ সময় লক্ষভেদী হলেও অনেক সময়ই ব্যর্থ হয়, রণাঙ্গনে সে কখনো হয় জয়ী, কখনো পরাজিত ও আহত। মৃত্যুর এই শক্তির মূল উৎস তার অসীম ধৈর্য এবং সহ্যক্ষমতা। মৃত্যু সীমাহীন এক ধৈর্য নিয়ে লড়ে যায় অবিরাম, সহ্য করে যায় প্রতিপক্ষের যাবতীয় আঘাত এবং নারকীয় এক পিপাসায় চেটে খেয়ে ফেলে তার জখমের রক্ত-পুঁজ, যা তার মধ্যে ছড়িয়ে দেয় সেই অপার শক্তি যার সামনে মৃত্যু প্রতিপক্ষরা কখনো টিকতে পারেনি।

মৃত্যুর এই নিশ্চিত ও ধারাবাহিক বিজয়ের একটা প্রধান কারণ তার জোটনিরপেক্ষতা। মানে মৃত্যু লড়াই করে একা একা, কোনো মিত্রপক্ষ বা জোটের সহযোগিতা ছাড়া। যাদের রণ অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন যুদ্ধক্ষেত্রে জোটনির্ভরতা বড় ধরনের দুর্বলতা। কারণ মিত্র জোট গড়তে গিয়ে সেনাপতিকে কখনো কখনো অন্যের কাছে দায়বদ্ধ বা তার হাতের পুতুল হয়ে যেতে হয়। আর এটা তো সবার জানা যে, খেলা শেষ হয়ে গেলে পুতুলের স্থান হয় ডাস্টবিন। সুতরাং যুদ্ধক্ষেত্রে জোটবদ্ধতা দুর্বলতার লক্ষণ, আর মৃত্যু সব ধরনের রণদুর্বলতা থেকে মুক্ত বলেই সব সময় যুদ্ধে জিতে থাকে। মুত্যৃ সব সময় লড়ে একা একা, কোনো মিত্র পক্ষের সাহায্য ছাড়া।

মৃত্যুকে যদি অন্যের সাহায্য নিয়ে, কারো কাছে দায়বদ্ধ হয়ে বা কারো হাতের পুতুল হয়ে লড়তে হতো তাহলে তার বিজয় কখনোই এতটা নিঃসংশয় হতো না। আমি আগেই বলেছি, মৃত্যু রূপকথার আদর্শবান, মহা মূল্যবোধসম্পন্ন কোনো রণনায়ক নয়, নিজের আদর্শ ও মূল্যবোধের মান বাঁচাতে গিয়ে রণাঙ্গনে যে অনেক কিছুই করতে পারে না। মৃত্যু বরং মহা ধূর্ত, চতুর, বহুরূপী ও মুখোশধারী এক যোদ্ধা। মৃত্যু কখনো কখনো আসে সাদা ঘোড়ায় চড়ে, নাঙ্গা তরবারি উঁচিয়ে… হঠাৎ এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। আবার কখনো সে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ না পাওয়া নারীর মতো পেছন থেকে আঘাত করে। কখনো আসে পায়ে হেঁটে বুক চিতিয়ে… আবার কখনো কখনো মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে… চার দিকে প্রতারণার জাল বিছিয়ে।

কত সুখী-সংসারী-মৃত্যু উদাসীন জীবন… কত ঘুমন্ত চোখ, স্বপ্নাতুর নয়ন… কত হাস্যোজ্জ্বল মুখ যে মৃত্যুর হঠাৎ অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে তার কোনো লেখাজোখা নেই। মৃত্যুর কাছে দয়া-মায়ার আশা করে লাভ নেই। মৃত্যু কাউকে দয়া করে না, কারো খাতির করে না, কারো পরিস্থিতির তোয়াক্কা করে না, মৃত্যু জীবনকে সম্মান করতে জানে না। মৃত্যু মায়ের দুধ পানরত শিশুর ঘাড়ে হঠাৎ দাঁত বসিয়ে দিতে পারে, মায়ের চোখের সামনে হত্যা করতে পারে অসহায় নবজাতককে, গর্ভবতীর মায়ের পেটে হাত ঢুকিয়ে প্রতীক্ষারত মায়ের স্বপ্নবিভোর চোখের সামনে বের করে আনতে পারে মৃত সন্তান, বাসরঘরে ঢুকে খুন করতে পারে স্বামী বা স্ত্রীর কোনো একজনকে, একঝাঁক শিশুকে এতিম বানিয়ে হত্যা করতে পারে বাবা-মাকে কিংবা বাবা-মাকে কাঁদিয়ে তাদের কোল থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে আদরের সন্তানদের সব স্বাদ-সুখ বিনষ্টকারী বিষের নাম মৃত্যু। হলুদ গ্রন্থগুলো থেকে আমরা মৃত্যুর এসব কাহিনী জানতে পারি।

সুতরাং মৃত্যুর প্রতি দয়া দেখিও না কিংবা তার কাছ থেকে কোনো দয়াপূর্ণ আচরণ আশা করো না। কারণ আমাদের এক অবধারিত ও চিরশত্র“র নাম মৃত্যু, যার সাথে কোনো অবস্থাতেই সন্ধির আশা করা যায় না। তাই বলি মৃত্যুর প্রতি কখনোই দয়া দেখিয়ো না, তার সামনে নিজেদের অসহায়ত্ব জাহির কোরো না। কারণ লাভ নেই। তোমরা যত অসহায়ই হও, তার কাছে যত আত্মসমপর্ণই করো না কেন সে তোমাদের এক ফোঁটাও দয়া করবে না। মৃত্যু কখনো সন্ধিতে আগ্রহী নয় এবং শান্তিপূর্ণ বসবাস বলতে যা বোঝায় সেটা ওর স্বভাবের মধ্যে নেই। ও আমার তাজা ফুলের মতো ভাইদের হত্যা করেছে। আমার পরিবারের লোকদের ক্ষুধার্ত রেখে রেখে অবশেষে বাধ্য করেছে তার রাজ্যপানে যাত্রা করতে। আমার ছোট ভাইদের ফুসলিয়ে বিলের ধারে নিয়ে গেছে, তার সাথে খেলার জন্য। তারপর ইহুদি বিষ খাইয়ে খুন করেছে তাদের। এভাবে মৃত্যু একে একে হত্যা করল আমার চার ভাই ও দুই বোনকে।

তারপর শুরু নির্দয় মৃত্যু এবং আমার বীরপুরুষ বাবার মধ্যে সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। ছয় সন্তান হারিয়ে বাবা ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত ও হিংস্র হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেভাবেই হোক তিনি মৃত্যুকে খুন করে তার সন্তানদের হত্যার প্রতিশোধ নেবেন। এক দিন শুরু হলো বাবা ও মৃত্যুর লড়াই, করবাজিয়া রণাঙ্গনে। মৃত্যু হাজির হলো ইটালিয়ান ও ইরিত্রিয়ান সৈন্যদের বেশে, জেনারেল মিয়ানির নেতৃত্বে, ঝাঁক ঝাঁক সিপাহি নিয়ে। বাবাকে হত্যা করার জন্য মৃত্যুর সে কী বিশাল আয়োজন! মৃত্যুকে খুনের নেশায় বাবা মৃত্যুর সিপাইরূপী জেনারেল মিয়ানির সৈন্যদের সমানে হত্যা করতে লাগলেন। বাবা অবাক হয়ে দেখলেন তার ডান-বাম চার দিকে মৃত্যুর শহীদরা টপাটপ ঝরে যাচ্ছে, আর প্রতিটি গুলি ছোড়ার সময় বাবা ভাবছেন এই বুঝি মৃত্যু শেষ। কিন্তু বাবাকে হতাশ ও হতবাক করে দিয়ে মৃত্যু অনড় রইল। এক সময় বাবার গুলি ফুরিয়ে গেল। শেষ গুলিটা ছুড়ে বাবা তার গুলিহীন বেল্টটা ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে উঠলেন : তোমাদের কারো কাছে গুলি আছে… আমাকে গুলি দাও, মৃত্যু বেটার শেষ না দেখে আমি আজ রণক্ষেত্র ছাড়ছি না। অদূরে এক গর্তে বসে থাকা এক যুবক যোদ্ধা উত্তর দিলো, জেনারেল আমার বেল্টটা নিয়ে যান, তাতে এখনো অনেক গুলি আছে। বাবা তার কাছে ছুটে গেলেন। কিন্তু হায়! বাবা পৌঁছে দেখলেন তার আগেই মৃত্যু পৌঁছে গেছে তার কাছে। তার মানে মৃত্যু দেখে এবং মানুষের কথা শুনতে পায়? হতে পারে।

তবে আমার বাবাও ছিলেন বীর যোদ্ধা এবং সে দিন তিনি মৃত্যুর মতোই নিষ্ঠুর ও হিংস্র হয়ে উঠেছিলেন। তাই তিনি দমলেন না। তিনি নিহত শহীদের কোমর থেকে গুলির বেল্ট খুলে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। এক সময় তিনি পিপাসায় কাতর হয়ে তার চাচা ‘খামিছ’-এর কাছে পানি চাইলেন। খামিছ বীর ভাতিজার জন্য পানি আনতে ইতালিয়ান সেনাদের ব্যূহ ভেদ করে পানি বহনকারী গাধাটার দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু মৃত্যু! মৃত্যু সবসময় তার লক্ষ্যে সবার আগে পৌঁছে যায় : মৃত্যুর লক্ষ্যভেদী গুলি এসে লাগল তার ডান চোখের ওপরে, তার মগজ ছিটকে পড়ল তার গায়ের ওপর। খামিছ শহীদ হয়ে গেলেন। বাবার মাথায় খুন চেপে বসল। উন্মাদের মতো তিনি পরিখার আড়াল থেকে উঠে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে গুলি ছুড়তে লাগলেন।

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিলেন : ‘আমরা মুসার সন্তান, হে কাপুরুষ মৃত্যু তুই যদি পুরুষ হয়ে থাকিস তাহলে বেরিয়ে আয় আমার সামনে’। কিন্তু আমি আগেই বলেছি, মৃত্যু সবসময় যুদ্ধ করে ঠাণ্ডা মাথায়, ধৈর্যের সাথে। কারো উত্তেজক কথায় উত্তেজিত হয়ে মৃত্যু কখনো কোনো ভুল করে না। বাবার সেই আহ্বানে মৃত্যু বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হলো না, আস্ফালন করে মাথা উঁচিয়ে বেরিয়ে এলো না বা হাত তুলে তার অবস্থান জানান দিলো না। বরং সে তার উত্তরে একঝাঁক গুলি পাঠাল। কিন্তু বাবার সেই উত্তেজক আহ্বানে সাড়া দিলো তারা হচ্ছে তার দলের একদল বীর তরুণ। তারা ‘আমরা হাজির সন্তান… আমরা হাজির সন্তান’ বলে চিৎকার করতে করতে পরিখার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে নির্ভয়ে, খোলা ময়দানে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর ওপর সরাসরি হামলা করল। আক্রমণকারী এই দলটার সাথে যোগ দেয়ার জন্য বাবা ছুটে গেলেন। কিন্তু মৃত্যু… মৃত্যু সবসময় সবার আগে পৌঁছে যায়। বাবা পৌঁছার আগেই মৃত্যুর বন্দুক ছুটে আসা ঝাঁক ঝাঁক গুলি তাদের মাটিতে ফেলে দিলো। মৃত্যু ও বাবার লড়াই যখন ভয়ঙ্কর রূপ নিলো তখন তার সাথীরা তাকে তার কাছে না যাওয়ার অনুরোধ করতে লাগল, যাতে তাকেও খামিছ, আতরাশ, ছাহবির মতো করুণ পরিণতি বরণ করতে না হয়। কিন্তু বাবা তাদের কথায় কান দিলেন না। বীরত্বের সাথে মৃত্যুর মোকাবেলা করে যেতে লাগলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেলেন। এক সময় মনে হলো মৃত্যুও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তার মনোবলে চির ধরেছে : মৃত্যু, আবার আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে সে দিনের মতো রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেল। তবে যাওয়ার আগে বাবার গায়ে রেখে গেল পাঁচটি গুলির আঘাত।

আমি তো আগেই বলেছি : মৃত্যুও কখনো কখনো পরাজিত হয়, আহত হয়ে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। তবে সে কখনোই পরাজয়ের গ্লানি বোধ করে না, হতাশ হয় না। কারণ তার আত্মবিশ্বাস হতাশা থেকে অনেক শক্তিশালী এবং চূড়ান্ত বিজয়ে তার আস্থা সাময়িক পরাজয় থেকে অনেক অনড়। তার কারণ মৃত্যু লড়াই করে তার নিজের শক্তিতে, আমেরিকার সাহায্যে নয়।

তিন বছর যেতে না যেতেই মৃত্যু আবার হামলা করল। এবারের রণক্ষেত্র ‘কিয়াফা’ এবং তা কারযাবিয়ার যুদ্ধ থেকেও ভয়ঙ্কর রূপ নিলো। এবার মৃত্যু এলো ইটালিয়ানদের মিত্র সানুছি সেনাবাহিনী নিয়ে। মৃত্যুর আশা ছিল এবার সে বাবাকে ফেলে দিতে পারবে। এবারে মৃত্যু ছিল অনেক বেশি বদ্ধপরিকর, লোক ও অস্ত্রশস্ত্রে ভরপুর এবং জয়ের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু বাবা তুলনামূলক অনেক দুর্বল হলেও মৃত্যুর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তাকে তেমন পাত্তাই দিলেন না। মৃত্যুর অট্টহাসিতে চরাচর কেঁপে উঠল, যখন সে দেখতে পেল মাঠ-ঘাট ছাপিয়ে, মরুর সোনালি বালু কালো করে দিয়ে তার মিত্র সানুছির কালো উর্দি পরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যরা পঙ্গপালের মতো এগিয়ে যাচ্ছে আর অপর দিকে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন গুটিকয়েক নিরস্ত্র ‘ভদ্রলোক’ নিয়ে।

সে দিনটা আসলেই খুব কঠিন ছিল। মৃত্যু হাজির হলো তার সম্পূর্ণ লোকবল অস্ত্রবলসহ। বাবা মাঠে নামলেন তার সাহস ও বীরত্ব সম্বল করে… মৃত্যুর সাথে তার মিত্র সানুছির বিশাল বাহিনী… বার সাথে গুটিকয়েক অনভিজ্ঞ যোদ্ধা। বাবা যখন বুঝতে পারলেন আজকের লড়াই হবে অসম লড়াই এবং আজ জয়ের আশা নিছক দূরাশা মাত্র তখন তিনি যাবতীয় রক্ষণাত্মকতা বাদ দিয়ে আক্রমণাত্মকভাবে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। মৃত্যুকে পাত্তাই দিলেন না, কোনো পরিখা খুঁড়লেন না… ঘোষণা দিলেন তারা আজ সরাসরি মুখোমুখি লড়াই করবেন… সে দিন হতাশা ও সাহস মিলে গিয়ে যে রূপ তৈরি হলো সেটা খুব সুন্দর ও ভয়ঙ্কর। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে দেখা গেল, কারবাযিয়ার দিনের মতোই, মৃত্যুর গুলিগুলো সব লাগছে বাবার সহযোদ্ধাদের গায়ে। তার গায়ে একটা গুলিও লাগছে না। তারপর যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, বুকে গুলি লাগা আহত যোদ্ধার মতো লাল সূর্যটা যখন দিগন্তের ওপারে ডুবে যেতে লাগল তখন ক্ষোভে, সারাদিন চেষ্টা করার পরও বাবাকে ফেলতে না পারার রাগে মৃত্যু প্রায় উন্মাদ হয়ে গেল। শেষ চেষ্টা হিসেবে মৃত্যু বাবাকে লক্ষ্য করে রাশিয়ার সম্রাটের কাছ থেকে পাওয়া ‘মোছকোভ’ তাক করল, তাক করল ঠিক তার কলজে লক্ষ্য করে। কিন্তু তার গুলিটা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য ভেদ করতে পারল না। গুলিটা বাবার বাম কাঁধে একটা বিপজ্জনক গর্ত করে দিয়ে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমি আগেই বলেছি, মৃত্যুর প্রতিটি গুলিই অব্যর্থ এবং লক্ষ্যভেদী হয়, এ ধারণাটা ঠিক নয়। সে কখনো ব্যর্থ এবং কখনো লক্ষ্যভেদী হয়। এবারও মৃত্যুর গুলি বাবাকে কবরে শোয়াতে পারল না। তবে তা আজীবনের জন্য তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বাবা চিরদিনের মতো আংশিক প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হলেন।

আমি বলেছি, মৃত্যু সব সময় সাহসী যোদ্ধার মতো আচরণ করে না, সব সময় বুক চিতিয়ে মুখামুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করে না। মাঝে মাঝে সে বরং খুব ভীরু হয়ে যায় এবং ধূর্ত কাপুরুষের মতো পেছন থেকে আঘাত করে। ‘মালাহ’ ‘কারজাবিয়া’র দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মৃত্যু কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এত আয়োজনের পরও বাবাকে হত্যা না করতে পেরে সে কিছুটা হতাশই হলো। তবে অভিশপ্ত মৃত্যু কখনোই চূড়ান্ত হতাশ হয় না। সে নিশ্চিত জানে, সে যতই পরাজিত হোক এবং তার প্রতিপক্ষ যতই জয়ী হোক সেটা সাময়িক, চূড়ান্ত বিজয়মালা তার গলাতেই উঠবে। তাই মৃত্যু বাবার ব্যাপারে আশা ছাড়ল না। তবে কাপুরুষ মৃত্যু এবার যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে অন্য রাস্তা ধরল : এবার সে হাজির হলো বিষাক্ত মরু সাপের বেশে। এক অন্ধকার রাতে মরু ঝোপের ভেতর থেকে উঠে এসে মৃত্যু ছোবল মারল বাবার পায়ে।

মহা মহা বীরেরা মৃত্যুর উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে যখন যুদ্ধের ময়দানে নামেন তখন মৃত্যু আসে সাদা ঘোড়ায় চড়ে, নাঙ্গা তরবারি উঁচিয়ে। তবে মৃত্যু যখন কারো ব্যাপারে কিছুটা হতাশ এবং প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যায় তখন ও আসে কালো ঘোড়ায় চড়ে। সরাসরি যুদ্ধে ব্যর্থ হওয়ার পর বাবার কাছে মৃত্যু এলো কালো ঘোড়ায় চড়ে, আত্মগোপন করে, চুপিচুপি। সরাসরি মুখামুখি না হয়ে আঘাত করল পেছন থেকে। যে মৃত্যুর ভয়ে দুনিয়াজুড়ে মানুষ প্রকম্পিত, সে মৃত্যু আমার বাবাকে খুন করতে এলো কালো বিষাক্ত মরু সাপ হয়ে। বাবা তার কঠিন পেশল পায়ে সাপটাকে প্রায় থেতলে দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে বাবার পায়ে বিষ ঢেলে দিলো। এবার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত ছিল। এই নির্জন মরুতে এই বিষ বাবাকে নিশ্চিত ফেলে দেবে। কিন্তু মৃত্যু জানে না বেঁচে থাকার ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা তার যাবতীয় চক্রান্ত বিনাশ করে দিতে পারে, মিথ্যা করে দিতে পারে তার সব আশা-ধারণা। তার জানা ছিল না এক কাপ সাধারণ লাল চা এই মরু সাপের বিষক্রিয়া নষ্ট করে দিতে পারে অতি সহজে। এক কাপ লাল চা পান করে এবং কয়েকবার বমি করার পর বাবা মৃত্যুকে গালি দিতে দিতে আবার উঠে দাঁড়ালেন।

কিন্তু আমরা তো আগেই জেনেছি, মৃত্যু যতই আহত হোক কখনোই মরে না, যতবারই হেরে যাক কখনো হতাশ হয় না। বাবা তার কঠিন, চিরঅনড় পায়ে সাপটাকে থেতলে দিলে শেষ মুহূর্তে মৃত্যু তার দেহ ছেড়ে বের হয়ে গেল এবং আরেকটা বিষাক্ত সাপের গায়ে আশ্রয় নিয়ে বাবার বাড়ি ফেরার পথে ওঁৎ পেতে রইল। ফেরার পথে এক যাত্রাবিরতিকালে আগুন জ্বালানোর জন্য বাবা একটা গাছের ডাল ভাঙার জন্য যেই হাত বাড়ালেন সাথে সাথে ওঁৎ পেতে থাকা মৃত্যু ছোবল মারল তার ডান হাতে। বাবার বিরুদ্ধে মৃত্যুর লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। সে ভালো করেই জানে তার এই প্রতিপক্ষ সহজে ঘায়েল হওয়ার নয়। সে তো জানে এর আগেরবার নির্জন মরুতে একা, তার সহযোদ্ধাদের থেকে অনেক দূরে থাকার পরও বাবা বেঁচে গেছেন। এবার তো তার লোকজন আছে তার সাথে। তার মোকাবেলার জন্য সবাই প্রস্তুত। তাই মৃত্যু এক ছোবল দিয়েই থেমে গেল না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে পরপর কয়েকটা ছোবল মারল। কিন্তু হায়রে বোকা! বোকা মৃত্যু বুঝতে পারল না, তার পরের ছোবলগুলোই তার বিষের বিষনাশক হয়ে বাবার গায়ে ছড়িয়ে পড়ল এবং এবার কাফেলায় লাল চা না থাকলেও, খোদ মৃত্যুর দাওয়াইতেই বাবা আবার তার হাত থেকে ফসকে গেলেন। সাপের বিষে বাবা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ দফাতেও বাবা বেঁচে গেলেন।

এ পর্যন্ত আমরা এই ড্রামা কাহিনীর যতটুকু জানলাম তাতে দেখছি : তার প্রথম পর্বগুলোতে মৃত্যু ছিল পুরুষ। কিন্তু শেষে সে হাজির হয় নারী হয়ে এবং তখন আমরা কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। কারণ আমরা দেখছি নারী মৃত্যু হাজির হয়েছে একটা বিষাক্ত নারী সাপ হয়ে। এখন…! এখন কী তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে নাকি লড়াই করতে হবে?… বিষাক্ত সাপের কাছে কী, যদি ও নারী হয় আত্মসমর্পণ করা যায়? সাপকে তো আমরা শত্র“ বলেই জানি, তাই না ?… আমার বাবাও তাই করলেন, নারী সাপের কাছে আত্মসমর্পণ না করে তার সাথে লড়ে গেলেন। সে যাই হোক। আমরা আমাদের বিষয়ে ফিরে যাই : এই গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা আসলে মৃত্যুর সেক্স নির্ধারণ করতে চাইছি, দেখতে চাইছি মৃত্যু পুরুষ না নারী এবং আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মৃত্যু যদি পুরুষ হয় তাহলে তার সাথে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে হবে আর যদি ও নারী হয় তাহলে আখেরি পলক পর্যন্ত তার কাছে আত্মসমর্পণ করে যেতে হবে।

এ নাগাদ আমরা গল্পটার যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছি তাতে দেখা যাচ্ছে বাবা এখনো লড়ে যাচ্ছেন, আত্মসমর্পণ করেননি, যা থেকে বোঝা যায় মৃত্যু পুরুষ। কিন্তু শেষে গিয়ে আমি নিশ্চিত হলাম, মৃত্যু পুরুষ নয়, নারী। নারীর আদিম ও শাশ্বত যাবতীয় রমণীয়তা নিয়েই নারী এবং আমার বাবা প্রকৃত পুরুষের মতোই বিনা দ্বিধায় সেই নারীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। ১৯৮৫ সালের ৮ মে বাবা তার কোলে শির সমর্পণ করেই আখেরি পলক ফেলেছিলেন। বাবা একটু নড়লেনও না, কোনো প্রতিবাদ করলেন না। তার আজীবনের স্বভাব অনুসারে হুঙ্কার দিয়ে তরবারি হাতে লাফিয়ে উঠলেন না। বরং তিনি তার হাতে বিনা দ্বিধায়, বিনা প্রতিবাদে আত্মসমর্পণ করলেন। বরং আমরা অবাক হয়ে দেখলাম বাবা মৃত্যুর পক্ষ নিয়ে অন্যদের বিরুদ্ধে, যারা মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়তে চাইছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম মৃত্যু নারী, বেশ রমণীয় কিছিমের নারী, যার কাছে আমার বীরপুরুষ বাবা বিনাপ্রতিবাদে আত্মসমর্পণ করছেন। এভাবে বাবা তার চিরশত্র“ মৃত্যুর রমণী রূপের কাছে আত্মসমর্পণ করে ইতিহাসে আরেকবার প্রমাণ করে গেলেন নারীর রমণীয়তার সামনে পৃথিবীর কোনো বীরত্বই টিকতে পারে না।

এগিয়ে আসছে মৃত্যুর শোভাযাত্রা, ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার ঢোলের শব্দ… হইচই…। ওই ভয়ঙ্কর ঢোল-বাদ্যের শব্দ যতই স্পষ্ট হলো বাবা তার সাথে সাথে বিছানায় এলিয়ে পড়তে লাগলেন। তাকে খুব শান্ত ও প্রশান্ত দেখাচ্ছিল। আমাদের দিকে তাকিয়ে তিনি শিশুর মতো অর্থহীনভাবে হাসতে লাগলেন। এই দৃশ্য দেখে অদ্ভুতভাবে আমার মনে হলো, মৃত্যুর শোভাযাত্রার ঢোল-বাদ্য যা শুনে অসুস্থ মানুষগুলো ভয়ে কেঁপে উঠে আসলে ভয়ঙ্কর কিছু না। তা বরং উম্মে কুলছুমের গান বা জনপ্রিয় কোনো মিসরি গানের মতো সুন্দর, শ্র“তিসুখকর এবং তা বাজিয়েই অসুস্থদের অবশ বা সংজ্ঞাহীন করে ফেলা সম্ভব। অসুস্থদের সংজ্ঞাহীন করার জন্য রাসায়নিক কোনো মেডিসিনের দরকার নেই, জনপ্রিয় কোনো মিসরীয় গানই যথেষ্ট। আমার এই অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে ডাক্তার সাহেব হতবাক হয়ে গেলেন, তার এলাকায় নাক গলাচ্ছি বলে বিরক্ত হলেন। আমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, কী কারণে এখন বাবাকে সংজ্ঞাহীন করানো উচিত, খুবই জরুরি এবং সেটা কোনো গান-ফান দিয়ে হবে না। তাকে দ্রুত ইনজেকশন দিয়ে সংজ্ঞাহীন করতে হবে। তার সেই শাস্ত্রীয় বয়ানের সামনে আমি নেহাত বোকা বনে গেলাম।

তাকে শান্ত করার জন্য লজ্জিত হয়ে বললাম : এ বিষয়ে আমি আসলেই গণ্ডমূর্খের পর্যায়ে। আমি আসলে সুস্থ ও অসুস্থের মাঝে গুলিয়ে ফেলেছি এবং মিসরীয় গানের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ধারণা পোষণ করে ফেলেছি। আমি ভেবেছিলাম মিসরীয় গান অসুস্থদের ওপরও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এখন বুঝতে পারছি সেটা ঠিক নয়। মিসরীয় গান প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, অবশ সংজ্ঞাহীন করে দেয় সুস্থ আরব জনগণকে, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ ১৯৪৮ সাল, যখন তার প্রতিক্রিয়ায় প্রায় এক মিলিয়নের বেশি আরব সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু অসুস্থদের সংজ্ঞাহীন করার জন্য এই গান তেমন কার্যকরী কিছু নয়, এটা প্রমাণিত সত্য। ডাক্তাররা বরং শারীরিকভাবে অসুস্থ লোকদের গান না শোনানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন, কারণ তাতে বমি হওয়ার মতো বিরূপ কিছু প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কিন্তু শারীরিকভাবে সুস্থ যারা বা মানসিক অসুস্থদের ব্যাপারে ডাক্তাররা গান শোনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তাতে তারা সাময়িক প্রশান্তি লাভ করতে পারেন, অরাসায়নিক উপায়ে কিছুক্ষণের জন্য অবশ বোধ করতে পারেন… যাহোক আমি যখন ডাক্তারকে বললাম : তবে গান কিন্তু সুস্থ-অসুস্থ সবার মন ও মানসিকতায় প্রভাব ফেলে, তখন তিনি আরো ক্ষেপে গেলেন। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন : দেখেন মশাই আমি সার্জন ডাক্তার, মন… আত্মা… মানসিকতা… মেজাজ… এগুলো আমার কাছে এক রাশ অর্থহীন শব্দ।

বাবা ক্রমশ হেলে পড়ছেন, ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাচ্ছেন। আমরা তার চার দিকে দাঁড়িয়ে কাঁদছি আর তিনি আবেশিত মুখে হাসতে হাসতে হারিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর রাজ্যে… হায়রে এই কী সেই মৃত্যু, বাবার আজীবনের শত্র“, যার চ্যালেঞ্জে সাড়া দিয়ে বাবা ‘কারযাবিয়া’ ‘তালা’ ‘মালাহ’ বিভিন্ন রণাঙ্গনে চরম বীরত্বের সাথে লড়েছেন? এই কী সেই বিষাক্ত সাপ যা নির্জন মরুতে বাবাকে দংশন করেছিল? যদি এই সেই মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে সে খুব চালাক, ধূর্ত এবং সফল প্রতারক। আমার যে বীর যোদ্ধা বাবা রণাঙ্গনে রণাঙ্গনে তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাকে আহত-পরাজিত করেছেন সে তিনিই আজ তার প্রতারণার জালে পা দিয়ে বিনা প্রতিবাদে তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন… তার মানে মৃত্যু পুরুষ নয়, নারী এবং আখেরি পলক পর্যন্ত তার কাছে আত্মসমর্পণ করে যেতে হবে। আমার বাবা তাই করলেন।

সুতরাং, মৃত্যু চিরবিজয়ী কোনো যোদ্ধা নয়। মৃত্যু বরং অধিকাংশ সময়ই পরাজিত হয়। মৃত্যু যখন হাজির হয় ঘোড়ার পিঠে চড়ে, অস্ত্র উঁচিয়ে, মুখোমুখি মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তখন মৃত্যু অধিকাংশ সময় হেরে যায়। কারণ মৃত্যুর এই রূপটা তার প্রতিপক্ষের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, তাকে প্রাণপণ লড়াই করতে বাধ্য করে… কারণ এ ক্ষেত্রে মৃত্যু হাজির হয় বীরপুরুষের মতো, যার সাথে লড়াই করা ছাড়া কোনো উপায় নেই, আর যোদ্ধারা ভালো করেই জানেন প্রাণপণ লড়াইয়ের একমাত্র পরিণতির নাম বিজয়। কিন্তু মৃত্যু যখন তার রণকৌশল বদলে, বীর যোদ্ধার পরিবর্তে রমণীয় নারীর বেশে হাজির হয়, তখন সে সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, তার কাক্সিক্ষত বিজয়ে পৌঁছে যায় অতি সহজে। কারণ বীর পুরুষরা কখনোই নারীর ওপর অস্ত্র তোলেন না। নারীর বিরুদ্ধে লড়া যায় না, নারীর কাছে আত্মসমর্পণ করে যেতে হয় আখেরি পলক পর্যন্ত… আর আত্মসমর্পণের ফলাফল কখনোই বিজয় হতে পারে না।

এভাবে মৃত্যু, লড়াই যত দীর্ঘই হোক, শেষ পর্যন্ত তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যায় এবং কখনোই তার প্রতিপক্ষের প্রতি দয়া করে না, সে যত কাকুতি-মিনতিই করুক, যত আত্মসমর্পণই করুক।
সুতরাং যদি দীর্ঘ জীবন চাও তাহলে মৃত্যুর মোকাবেলা করে যাও, আমার মহান বাবার মতো, যিনি কখনোই মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেননি, চরম সাহসিকতার সাথে তার সাথে লড়ে এক শ’ বছর বেঁচেছিলেন, যদিও মৃত্যু ত্রিশ বছর বয়সেই তাকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। দীর্ঘ জীবন লাভ এবং মৃত্যু থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় তার মোকাবেল করা, অবিরাম তার সাথে লড়ে যাওয়া। পালানো?… মৃত্যুর হাত থেকে পালানোর চেষ্টা সবসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

মৃত্যুর কাছ থেকে পালানো সম্ভব নয়। কিন্তু মৃত্যু যদি অবলা অস্ত্রহীন নারীর বেশে আমাদের কাছে এসে হাজির হয়, কোমল রমণীয়তা ছড়িয়ে আমাদের ঘরে ঢুকে, ভালোবাসা-সোহাগে আমাদের মাতিয়ে দেয়, কাতুকুতু দিয়ে হাসায়…তাহলে তার সাথে লড়াই করাটা কখনোই প্রকৃত পৌরুষত্বের পরিচয় হতে পারে না। তখন বরং কর্তব্য হচ্ছে প্রকৃত পুরুষের মতো, আখেরি পলক পর্যন্ত তার কোলে আত্মসমর্পণ করে যাওয়া…
মরণকালে রমণী মৃতুর কোলে আত্মসমর্পণ করে বাবা প্রমাণ করে গেলেন বীর যোদ্ধার সাথে তিনি প্রকৃত পুরুষও ছিলেন…। মূল : মুআম্মার আল-গাদ্দাফি-লিবিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট, অনুবাদ : ফয়সাল বিন খালিদ।



মন্তব্য চালু নেই