ভারতে এই প্রথম কৃত্রিম বৃষ্টি

বৃষ্টির দেখা নেই। পুজো-পাঠ-যজ্ঞি-আচ্চা নানান স্তরে নানান ভাবে করছেন খরাপীড়িত কৃষকরা। সরকার অসহায় ভাবে দেখছে একের পর এক কৃষকের আত্মহত্যা। মহারাষ্ট্রের এই চিত্র গোটা দেশকে যেমন চিন্তায় ফেলেছে, তেমনই অস্বস্তিতে ফেলেছে ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি-দেওয়া নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি-কে। এই অবস্থায় চাতক-প্রতীক্ষায় না থেকে কৃত্রিম বৃষ্টি নামাতে তৎপর হল মহারাষ্ট্র সরকার। কৃত্রিম মেঘ-সঞ্চারী প্রযুক্তির মাধ্যমে এইরকম বৃষ্টি নামানো ধনী বিশ্বের কোনও কোনও প্রান্তে বেনজির না হলেও ভারতে সম্ভবত এই প্রথম। সফল হলে, মহারাষ্ট্রের আত্মহননকারী কৃষক পরিবারের আর্তনাদ-বিদীর্ণ আকাশে খুব শীঘ্রই সৃষ্টি হবে মেঘ, নেমে আসবে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি।

রাজ্যের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী একনাথ খড়সে জানাচ্ছেন, বিষয়টি নিয়ে এর মধ্যেই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর। এই পদ্ধতিতে একটি ‘সুগার প্রপেলড্’ রকেট ব্যবহার করা হবে। ব্যবহার করা হবে সিলভার আয়োডিনও। রকেটটি গিয়ে ফেটে যাবে মেঘের মধ্যে এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কৃত্রিম বৃষ্টি নামাবে। এই রকেট প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই সিন্ধুদুর্গ এবং সাংলিতে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, ৪৫ কিলোমিটার রেঞ্জের ‘টার্গেট’-এর লক্ষ্যবস্তুতে ‘আঘাত’ হানতে সক্ষম। ৪০-৬০ মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি আনতে পারে এই প্রযুক্তি।

এ পথে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায়ও বোধ হয় নেই মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিসের। কারণ বিশ্লেষণ করছেন দিল্লি থেকে আমাদের প্রতিনিধি অনমিত্র সেনগুপ্ত।

সরকারে আসার পরে এক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কৃষক আত্মহত্যা থামার কোনও লক্ষণ নেই গোটা দেশ জুড়ে। পরিসংখ্যান বলছে কেবল মহারাষ্ট্রেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন প্রায় ১০৮৮ জন কৃষক। গতবারের চেয়ে যা ৪০ শতাংশ বেশি। সমস্যা কিন্তু এখানেই থামছে না মোদী সরকারের জন্য। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ছ’বছর বাদে ফের ভয়াল খরার মুখে দাঁড়িয়ে গোটা দেশ। অন্তত এমনটাই পূর্বাভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় আবহওয়া দফতর।

চাষী মৃত্যু নতুন কোনও সমস্যা না হলেও, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে মোদীর নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম বিষয় ছিল, ক্ষমতায় এলেই এক বছরের মধ্যে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা তিনি রুখে দেবেন। ফসলের ক্ষতি হলে চাষীদের যাতে চরম পথ বেছে না নিতে হয় তার জন্য একাধিক পদক্ষেপ করার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এক বছর পার হওয়ার পরে মোদির ‘অচ্ছে দিন’-এর দাবিকে কার্যত একাই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে কৃষক আত্মহ্ত্যার ঘটনা। সরকারি হিসাবে সংখ্যাটি অনেক কম হলেও, বাস্তব সংখ্যাটি যে অনেক বেশি তা মেনে নিচ্ছে কৃষিমন্ত্রকও। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার পঞ্জাবের ফতেগঢ় সাহিব জেলার দাদুমাজরা গ্রামে আত্মহত্যা করেন সুরজিৎ সিংহ নামে এক কৃষক।

গত ২৮ এপ্রিল রাহুল গাঁধী পঞ্জাব সফরে গেলে তাঁর কাছে প্রতিকার চেয়ে দ্বারস্থ হয়েছিলেন ওই কৃষক। প্রতিকারের দায় কার ছিল- এই প্রশ্নে সুরজিতের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দোষারোপের খেলায় নেমে পড়েছে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় পক্ষই। তবে সমস্যা শুধু মহারাষ্ট্র বা পঞ্জাবেই নয়। পশ্চিমবঙ্গেও চলতি বছরে জনা ত্রিশেক কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। যাদের মধ্যে অধিকাংশই আলু চাষী। মূলত আলুর দাম না পাওয়ার কারণেই ওই আত্মহত্যা।

কিন্তু মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সমস্যা যে গুরুতর তা স্বীকার করে নিচ্ছেন কৃষিমন্ত্রকের কর্তারা। বিদর্ভ এলাকার কটন বেল্টেই কেবল আত্মহত্যা করেছেন ৫৬৪ জন কৃষক। মরাঠাওয়াড়া রয়েছে পরের ধাপেই। নাসিকে পেঁয়াজ চাষ লাভের মুখ না দেখায় আত্মঘাতী হয়েছেন প্রায় ১৩০ জন। এই পরিস্থিতিতে মহারাষ্ট্রের কৃষকদের অবস্থার উন্নতির জন্য সার্বিক প্যাকেজের প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করছে কৃষিমন্ত্রক।

মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার দাবি করেছে, ইতিমধ্যেই চাষীদের জন্য ১৬০০ কোটি টাকার শস্য বিমা করা হয়েছে। ৯০ লাখ কৃষকদের জন্য অনুদান বরাদ্দ করা হয়েছে ৪০০০ কোটি টাকা। কিন্তু কৃষিমন্ত্রকের এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘লাল ফিতের ফাঁস পার হয়ে ওই টাকা আদৌ শেষ পর্যন্ত আসল কৃষকদের কাছে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা চক্রান্ত করে নিজেদের লোকেদের ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দিতে ব্যস্ত। বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত চাষীরা।’’

গোটা দেশেই কৃষকদের পরিস্থিতি এমনিতেই খারাপ। এ বছর বৃষ্টিপাত ৮৮ থেকে ৯০ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে মৌসম ভবন। যার ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপক ভাবে মার খাবে বলে আশঙ্কা। যার প্রভাব পড়বে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেও।

তাই আগে থাকতেই হাল ধরতে তৎপর হয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। জলের অভাব মেটাতে সেচের আওতায় যাতে আরও বেশি করে জমি নিয়ে আসা সম্ভব হয় তার আর্জি জানিয়েছেন মোদী। উদ্দেশ্য, চাষের জমিতে জলের ব্যবহার নিশ্চিত করা। যাতে ঘাটতি বর্ষা হলেও তার প্রভাব চাষের উপর না পড়ে। কিন্তু কৃষিমন্ত্রকের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের অর্ধেকের বেশি জমিতে সেচের ব্যবস্থা নেই। ফলে তাদের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলা বর্যার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়।

তাই প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগী হলেও পরিস্থিতি কি আদৌ পাল্টাবে? কমবে কি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা? নজর আপাতত সে দিকেই।



মন্তব্য চালু নেই