ব্রিটেনের প্রথম যুগের মুসলিমরা
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্নিটি অব লন্ডনের রেনেসাঁস স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক জেরি ব্রোটন তার সাম্প্রতিক ‘দিজ অরিয়েন্ট আইজল: এলিজাবেথান ইংল্যান্ড অ্যান্ড দ্য ইসলামিক ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে লিখেছেন, এলিজাবেথ যুগের যুক্তরাজ্যকে বুঝতে হলে ষোল শতক একটি বিশেষ সময়। তবে ওই সময়ের যুক্তরাজ্যকে যারা বুঝতে চায় তাদের অনেক কম লোকই বুঝতে পারে যে ওই সময়টাতেই ব্রিটেনে মুসলিমরা প্রথম প্রকাশ্যে বসবাস করতে শুরু করেছিল। স্বতস্ফূর্তভাবে তারা নিজেদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারতো এবং নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের চর্চা করতে পারতো।
বইটিতে তিনি ব্রিটেনে মুসলিমদের প্রথম দিকের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সে সময়ে ব্রিটেনে ধর্মীয় সম্প্রীতি আর পারস্পারিক বোঝাপড়ামূলক একটি সম্পর্ক মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে। মুসলিম এবং খ্রিস্টান উভয়ই এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে তখন। বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে, ব্রিটেনে মুসলিমদের নানা কর্মকাণ্ডের কথা:
উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়া থেকে অনেক দূরে হওয়া সত্ত্বেও ষোল শতকে যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ছিল মুসলিমরা। কূটনীতিবিদ, বড় বড় ব্যবসায়ী, অনুবাদক, সঙ্গীতশিল্পী, চাকর এমনকি পতিতা পর্যন্ত ছিল মুসলিমদের মধ্যে। এর কারণ, ওই সময়ে ক্যাথলিক ইউরোপীয় ধারণা থেকে সরে এসেছিলেন রানী এলিজাবেথ। ১৫৭০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পোপতন্ত্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন রানী। এর ফলে চার্চের নিয়ম নীতির বাইরে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ হয় তার।
আগে থেকেই মুসলিমদের সাথে খ্রিস্টানদের ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল চার্চ। এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এলিজাবেথ। মরক্কো, উসমানীয় সাম্রাজ্য এবং শিয়া অধ্যুষিত পারস্য সাম্রাজ্যসহ আরো বিভিন্ন মুসলিম দেশের সাথে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন তিনি। ধর্মীয় বিদ্বেষ দূরীকরণে মুসলিম দেশগুলোতে প্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ী পাঠাতে শুরু করেন রানী এলিজাবেথ। এর ফলে ‘মুর’, ‘ভারতীয়’, ‘নিগ্রো’ এবং ‘তুর্কি’ মুসলিমরা লন্ডনে যেতে শুরু করে।
এলিজাবেথের শাসনামলের আগে বাকি খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের মতো ইংল্যান্ডও ইসলামের ব্যাপারে ভুল ধারণার মধ্যে ছিল। এর কারণ ছিল প্রধানত ক্রুসেডের রক্তাক্ত এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা। সে সময়ে কোনো খ্রিস্টান ‘ইসলাম’ বা ‘মুসলিম’ শব্দটি পর্যন্ত জানতো না। সতের শতকে ইংরেজি ভাষায় শব্দগুলো প্রবেশ করে। মুসলিমদের তারা বলতো ‘সারাসিন’। পশ্চিমা দেশগুলোতে মনে করা হয়, নবী ইব্রাহিমের একজন অবৈধ সন্তানের নাম সারাসিন, যে ১২টি আরব উপজাতির প্রতিষ্ঠাতা।
তখন ইসলামকে একটি সুসংগত ধর্মবিশ্বাস হিসেবে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারতো না খ্রিস্টানরা। বরং ইসলামকে তারা একটি পৌত্তলিক বহুত্ববাদী ধর্ম বা খ্রিস্টান ধর্মের বিকৃত রূপ বলে প্রত্যাখ্যান করতো। তখন থেকেই মুসলিমদের বোঝাতে ‘ইফিদেল’ (নাস্তিক) শব্দটি ব্যবহার করা হতো। মুসলিমরাও সচেতনভাবে খিস্টান দেশগুলো ভ্রমণ এড়িয়ে চলতো। ওই দেশগুলোকে তারা বলতো ‘হাউজ অব ওয়ার’ বা যুদ্ধের ঘর। ‘হাউজ অব ইসলাম’র বিপরীত হিসেবে ‘হাউজ অব ওয়ার’ ব্যবহার করতো তারা।
রানী এলিজাবেথের সময় থেকেই এ ধারার পরিবর্তন শুরু হয়। ১৫৬২ সালে রানীর একদল ব্যবসায়ী প্রতিনিধি পারস্যের সম্রাট শাহ তাহমাস্প’র দরবারে হাজির হয় সেখান থেকেই প্রথম তারা শিয়া-সুন্নি বিশ্বাসগত পার্থক্যের কথা জানতে পারেন তারা। এরপর তারা লন্ডনে ফিরে গিয়ে বিষয়টি জানান রানীকে। পারস্য থেকে যাওয়ার সময় ‘আওরা সুলতানা’ নামে এক তাতার মুসলিম দাসীকে রানীর জন্য নিয়ে যান তারা।
পরে রানী এলিজাবেথের প্রিয় এবং বিশ্বস্ত দাসীতে পরিণত হয়েছিলেন আওরা। রানী তাকে গ্রানাডার নামকরা এবং মূল্যবান রেশমি জামাকাপড় পরাতেন। ফ্যাশন হিসেবে এলিজাবেথের জন্য স্পেনীয় চামড়ার জুতার প্রচলন করেছিল আওরা সুলতানাই। এরপর ইসলামি দেশগুলো থেকে অনেকেই শুরু করে লন্ডন যাত্রা।
১৫৮৬ সালে কলম্বিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসে ফ্রান্সিস ড্রেক। তার সাথে কলম্বিয়া থেকে আসে কয়েকশ তুর্কি মুসলিম। ভূমধ্যসাগর থেকে স্পেনীয়রা গ্রেপ্তার করেছিল ড্রেককে। ড্রেকের সাথে যুক্তরাজ্যে আসা একজন তুর্কির নাম শিয়ানো। তিনিই প্রথম কোনো মুসলিম, যে খ্রিস্টান প্রটেস্টেন্টবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
‘টাওয়ার অব লন্ডন’র পাশে সেন্ট ক্যাথেরিন চার্চে শিয়ানো ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তিনি উইলিয়াম হকিন্স নাম ধারণ করেন। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের পর প্রচার করতে থাকেন, ‘যদি ব্রিটেনে কোনো ঈশ্বর না থাকে, তবে কোথাও কোনো ঈশ্বর নেই।’ এর মাধ্যমে তিনি মূলত তার ‘ইংরেজ’ পরিচয়টি ফুটিয়ে তুলতে চাইতেন। তার ইংরেজ প্রভুদের সন্তুষ্টি পেতে চাইতেন। শুধু শিয়ানোই নয়, তার মতো আরো অনেক নারী-পুরুষই খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তখন। অবশ্য অনেকের বিশ্বাসের বিষয়টি অজানা থেকে গিয়েছিল।
তবে ধর্মান্তরের বিষয়টি শুধু একপাক্ষিক ছিল না। অনেক খ্রিস্টান নারী-পুরুষ ভাগ্যের সন্ধানে মুসলিম দেশগুলোতে ভ্রমণ করতে শুরু করে। তাদের অনেকেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। ১৫৭৭ সালে আলজেরিয়ায় তুর্কি জলদস্যুদের হাতে বন্দী হন ব্রিটেনের নামকরা ব্যবসায়ী স্যামসন রাওলি। কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছিল তাকে। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নাম ধারণ করেন হাসান আগা। আলজেরিয়ার প্রধান হিসাব রক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া অটোম্যান গভর্নরের সবচেয়ে আস্থাভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হন স্যামসন। আর কখনোই যুক্তরাজ্যে ফিরে যাননি তিনি।
উসমানীয়, পারস্য এবং মরক্কো সাম্রাজ্যের সাথে মিত্রতা থাকার কারণে অনেক মুসলিম এলিটদেরই ব্রিটেনে নিয়ে গিয়েছিলেন এলিজাবেথ। দলিলপত্রে দেখা যায়, ১৫৮০ সালে তুর্কি কূটনীতিবিদদের ব্রিটেনে পাঠানো হয়েছিল। ১৫৮৯ সালে লন্ডনে কূটনৈতিক মিশনের দায়িত্ব পালন করতে যান মরক্কোর কর্মকর্তারা। সে সময় স্বাধীনভাবেই নিজেদের ধর্ম চর্চা করতেন তারা। গবাদিপশু জবাই দিয়ে উৎসবও পালন করতেন তারা। জবাই করার সময় পশুর মুখ পশ্চিম দিকে ফিরিয়ে নেয়া হতো।
ব্রিটেনের প্রথম যুগের মুসলিমদের ব্যাপারে এমন আরো অসংখ্য তথ্য উপাত্ত আছে জেরি ব্রোটনের বইয়ে। এ থেকে বোঝা যায়, ঐতিহাসিকভাবেই মুসলিমরা ব্রিটেনের একটি অংশ। ব্রিটেনে মুসলিমদের ইতিহাস অনেকের ধারণার চেয়ে পুরনো।
মন্তব্য চালু নেই