ব্রিটিশদের লজ্জার তালিকা!

ব্রিটেনে দাস প্রথার অবসান হয়েছে প্রায় দু’শ বছর হতে চললো। বর্বর এই প্রথা অবসানের পেছনে যেমন আছে অনেক সংগ্রামের ইতিহাস। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক এই অধ্যায়টির সঙ্গে জড়িত ছিল কয়েক লাখ মানুষ। এসব মানুষ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীসহ বিখ্যাত সব মানুষদের রক্ত সম্পর্কীয় পূর্বপুরুষ।

ব্রিটেনের ৪৬ হাজার লোক আফ্রিকার আট লাখ দাসের মনিব ছিল। আর তাদের মুক্তি দিয়ে দাস প্রথার অবসানের জন্য এই ৪৬ হাজার লোককে সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। ক্ষতিপূরণের অংকটাও ছিল অবাক করার মতো! দুই কোটি পাউন্ড, যা বর্তমান বাজারদরে ১ হাজার ৭০০ কোটি পাউন্ডের সমান! এটি ২০০৯ সালে ইউরোপের বেইলআউটের আগে সবচেয়ে বড় অংকের কোনো সরকারি ক্ষতিপূরণ।

আর এই ক্ষতিপূরণ পাওয়া লোকদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, তার স্ত্রী সামান্থা, অভিনেতা বেনেডিক্ট কিউম্বারব্যাচ ও বেন অ্যাফলেকের দাদা পর দাদারা। অর্থাৎ আজকে যারা গণতন্ত্রের বুলি আওড়াচ্ছেন তাদেরই পূর্বসূরীরা বর্বর এই দাসবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর নৃশংস এই প্রথা অবলোপনে বিন্দুমাত্রও ক্ষতির শিকার হননি তারা। বরং ক্ষেত্র বিশেষে লাভবানই হয়েছেন।

দাস প্রথা অবসানে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে পাঁচ বছর ধরে সমস্ত তথ্য একত্রিত করেছে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন। আর এসব তথ্য নিয়ে গত বুধবার দুই পর্বের প্রামণ্যচিত্র প্রচার করতে যাচ্ছে বিবিসি।

১৮৩৩ সালে ব্রিটেনে দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। এর আগে আট লাখ আফ্রিকান দাসের মালিক ৪৬ হাজার ব্রিটিশকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য দাস ক্ষতিপূরণ কমিশন গঠন করা হয়। এসব দাসকে মালিকরা ক্যারিবীয় (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) অঞ্চলে আখ ক্ষেতে ব্যবহার করতো। কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, ১৫ শতাংশ ব্রিটিশ অভিজাত এই দাস বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

এছাড়া পাদ্রি, দোকানদার এমনকি সাধারণ মানুষও এসব দাসদের মালিক ছিল। দাসপ্রথা বিলোপ করে দেয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে কমিশন তাদের দুই কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দেয়, যা বর্তমান বাজার দর হিসেবে ১ হাজার ৭০০ পাউন্ডের সমান।

গবেষক দলের প্রধান ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ক্যাথিরিন হল ও ড. নিব ড্র্যাপার ক্ষতিপূরণ পাওয়া এসব লোকদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন। তালিকাটি তারা অনলাইনে প্রকাশ করেছেন। এই তালিকায় নজর দিলে সহজেই বুঝা যায়, কতো দাস ছিল এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে তারা কত টাকা পেয়েছেন!

তালিকা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ইওয়ার্ট গ্লাডস্টনের বাবা জন গ্লাডস্টন, যার নয়টি আখ ক্ষেত ছিল। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৭৬৯ পাউন্ড, বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী যা আট কোটি পাউন্ডের সমান।

বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের দাদা চার্লস ব্লেয়ার পেয়েছিলেন ৪ হাজার ৪৪২ পাউন্ড যা বর্তমানের তিন কোটি পাউন্ডের সমান।

অপরদিকে বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের আত্মীয় সেনা কর্মকর্তা ও ব্যানফশায়ারের সংসদ সদস্য জেনারেল স্যার জেমস ডাফ বর্তমান বাজার দরে তিন কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। জ্যামাইকাতে তার একটি আখ ক্ষেত ছিল।

ক্যামেরনের স্ত্রী সামান্থার পূর্ব পুরুষ ব্যবসায়ী উইলিয়াম জল্লিফ ১৬৪ জন দাসের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছিলেন চার হাজার পাউন্ড, যা বর্তমানে সোয়া তিন কোটি পাউন্ডের সমান।

গত বছর পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অভিনেতা বেনেডিক্ট কিউম্বারব্যাচের পূর্বপুরুষদের বারবাডোসে একটি আখ ক্ষেত ছিল। সেখানে তারা আড়াইশ দাসের মালিক ছিলেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তারা পেয়েছিলেন ছয় হাজার পাউন্ড, যা বর্তমানে ৩ কোটি ৬০ লাখ পাউন্ডের সমান।

ব্রিটিশ দাস মালিকদের এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, যারা আজ নিজেদের অভিজাত বলে দাবি করছেন, দাসদের রক্তেই গড়ে উঠেছে তাদের প্রাচুর্য। শেষ বেলায় যখন এই অমানবিক প্রথাটি বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তখনও নিজেদের লাভটুকু ছাড়তে রাজি হননি তারা।



মন্তব্য চালু নেই