বুশ এবং ব্লেয়ারের মিথ্যাচার
গত মাসেই মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ শান্তি দূতের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন টনি ব্লেয়ার। যদিও তার এই পদত্যাগ অতটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল না। উপরন্তু যুক্তরাজ্যে নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মে দেখানো হয় যে, জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং টনি ব্লেয়ার মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাতময় পরিস্থিতির মাঝে দাড়িয়ে আছেন। ‘উই আর মেনি’ নামের এই ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেছেন আমির আমিরানি। গত সপ্তাহেই হে উৎসবে এই চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে কিভাবে ইরাক যুদ্ধে জড়িয়ে যায় যুক্তরাজ্য এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সকল প্রতিবাদ উপেক্ষা করে কিভাবে তারা আগ্রাসন চালায়।
২০০৩ সালে প্রায় ৬০টি দেশের কয়েক মিলিয়ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ৮০০টি শহরে ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিল। ওটা ছিল লন্ডনের প্রতিবাদ সমাবেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়, কারণ এর আগে কোনো প্রতিবাদ সমাবেশে লন্ডনের দেড় মিলিয়ন মানুষ রাস্তায় নামেনি। স্পেনের মাদ্রিদে সেই প্রতিবাদে মানুষ হয়েছিল প্রায় দেড় মিলিয়ন এবং রোমে হয়েছিল তিন মিলিয়ন। এই বিশাল সংখ্যাকে কোনো ভাবেই অগ্রাহ্য করা উপায় নেই। অথচ সিরিয়ায় অল্প কিছু সংখ্যক বিদ্রোহীর ডাকে সাড়া দিয়ে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাজ্য নির্দিধায় যুদ্ধের নামে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে।
২০০৩ সালের ওইরকম তীব্র প্রতিবাদ স্বত্ত্বেও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা ইরাকে হামলা চালায়। হামলার তিন সপ্তাহ আগেই ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্র আছে কিনা এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান হ্যান্স ব্লিস্ক জানিয়েছিলেন যে সাদ্দাম হুসেইন বৃহৎ ধ্বংসযজ্ঞের জন্য কোনো অস্ত্র লুকিয়ে রাখেনি। কিন্তু বুশ এবং ব্লেয়ার চায়নি যে ব্লিস্ক ইরাকে তার কাজ শেষ করুন, আর এটাও সত্যি যে তারা কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের তোয়াক্কা করে না। তারা শুধু চাইছিল ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে তেলের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে, সেটা যেকোনো মূল্যেই হোক না কেন।
ইরাক যুদ্ধের ব্যয়ও ছিল বেশ বিশাল অংকের। ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৪৪৯১জন আমেরিকান সৈন্য মারা যায় ইরাকে। বুশ-ব্লেয়ার পক্ষের সৈন্যদের নিহত হওয়ার তালিকা সঠিকভাবে রাখা হলেও কতজন ইরাকি সৈন্য নিহত হয়েছিল তার কোনে সঠিক পরিসংখ্যান আমরা জানতে পারি না। তবে বিভিন্ন সূত্রের পরিসংখ্যান মনে, দেড় লাখ থেকে দুই লাখ ইরাকিকে হত্যা করা হয়েছিল তখন। ওই যুদ্ধে ইরাকের শুধুমাত্র রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই ধ্বংস হয়নি, পাশাপাশি দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠি এবং ধর্মীয় দলগুলোর মাঝেও বিভেদ তৈরি করেছিল। আজকের দিনের বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইরাকের ২৫ শতাংশ শিশুই অপুষ্টিতে আক্রান্ত।
আমিরানি দীর্ঘদিন ধরেই এই ডকুমেন্টারিটি তৈরির চেষ্টা করছিলেন। তার প্রায় নয় বছর লেগে যায় ওই ডকুমেন্টারিটি তৈরি করতে। প্রথমে আমিরানি ভেবেছিলেন যে তিনি ইরাক যুদ্ধ নিয়ে একটি গল্প বলবেন তার ডকুমেন্টারি মারফত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি টের পান আসলে গল্প বলার চেয়েও বিষয়টা আরও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। ইরাকের অবস্থা প্রেক্ষিতে যে কথা গুলো তাকে বলতে হচ্ছে তা আসলে অতীব প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজনীয়তার তাগিদ থেকেই সৃষ্টি ‘উই আর মেনি’।
ডকুমেন্টারিটিতে আরও একটি চরিত্র উঠে আসে যাকে এখন আর কোনো আলোচনায় আনা হয় না। সেই চরিত্রটির নাম ডোনাল্ড রামুসফেল্ড। বুশ-ব্লেয়ারের পরই রামুসফেল্ডকে সবচেয়ে বেশি দায়ি করা হয় ইরাক যুদ্ধের জন্য। পরিদর্শক হ্যান্সের আসল রিপোর্টকে অন্তরালে রেখে ভুয়া রিপোর্ট প্রকাশের প্রথম নীলনক্সাটিই করেছিলেন তিনি। তারই নির্দেশে সর্বপ্রথম ইরাকে গোপনে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো হয়েছিল। আর সেই গোয়েন্দা তৎপরতাকেই পরবর্তীতে ইরাক যুদ্ধের বৈধতা হিসেবে দেখানো হয়।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হচ্ছে সিরিয়ায়। বেশিরভাগ সামরিক বিশ্লেষকরাই বলছেন যে গোটা মধ্যপ্রাচ্য এখন একটি বিশাল ধ্বংসস্তুপ। কিন্তু তারা এটা বলছেন না যে, বুশ-ব্লেয়ারের মিথ্যাচারের কারণে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্স এবং তার মিত্রদের বিপুল সংখ্যক সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছে এবং এক দীর্ঘ অসন্তোষের জন্ম নিয়েছে ওই দেশগুলোতে। কূটনৈতিক আলাপচারিতার মাধ্যমে যে সমস্যার সমাধাণ করা যেতো সেটা অস্ত্রের মাধ্যমে সমাধান করার কারণে যে জাতীয় হতাশা দেখা দিয়েছে, তাতে আজ গোটা ইউরোপ আক্রান্ত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন জনতার ভেতর যে হতাশার জন্ম নিয়েছিল বর্তমানে সেই হতাশা কয়েকগুন বেড়ে অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। যে কারণে ইসলামিক স্টেটের মতো একটি সন্ত্রাসী সংগঠনেও ইউরোপ থেকে অনেক কোমলমতি যুবক-যুবতী যোগ দিচ্ছে, অথচ তারা এমন দেশ থেকে সিরিয়া-ইরাকে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে যেখানে তাদের জীবনযাপনের সকল সুযোগ ছিল। তাহলে কেন তারা জেনেশুনে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে? জাতীয় হতাশাই কি এর অন্যতম কারণ নয়।
মন্তব্য চালু নেই