বিদ্রোহী ‘লিলিথ’ উপাখ্যান

ইসলাম ধর্মগ্রন্থ অনুসারে সৃষ্টির আদিতে ছিলেন প্রথম মানব আদম (আঃ) এবং তারপর প্রথম মানবী হাওয়া (আঃ)। হাওয়াকে সৃষ্টিকর্তা তৈরি করেছিলেন আদমের পাঁজরের একটি হাঁড় থেকে। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থও একই কথা বলে। শুধু আদমকে তারা বলেছেন, ‘অ্যাডাম’ এবং হাওয়াকে বলেছেন ‘ইভ’। ইসলাম ধর্মগ্রন্থের আদি রূপ কিন্তু আবার ইহুদি ধর্মগ্রন্থ। যে কারণে ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে মিল এবং অমিল দুটোই উপস্থিত। তবে কোরআন শরিফ সবার শেষে নাজিল হওয়ায় এটা হচ্ছে ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থের সর্বশেষ রূপ। আদম এবং হাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু ইহুদিরাও দ্বিমত পোষণ করেন না, বরং সেখানে এর সাথে যোগ করা ছিল আরও বেশি কিছু। ইহুদিদের প্রাচীন ও সর্বপ্রথম ধর্মগ্রন্থ ‘দ্যা বুক অব জেনেসিস’ এ বলা ছিল- প্রথম মানবী ইভ নয়, অন্য আরেকজন। ইভের আগেও আরেকজন নারী ছিলেন আদমের জীবনে। হাওয়ার মত আদমের শরীরের কোন অংশ থেকে তাকে তৈরি করা হয়নি। সৃষ্টিকর্তা আদমকে পৃথিবীর যে মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন, তাকেও সেই একই মাটি দিয়ে একইসময়ে তৈরি করেছিলেন। তিনি ছিলেন আদমের প্রথম ‘রহস্যময় এবং বিদ্রোহী স্ত্রী’ – লিলিথ।

লিলিথ শব্দের প্রচলিত অর্থ রাত্রি। লিলিথের অস্তিত্ব নিয়ে চালু রয়েছে একের অধিক উপাখ্যান। প্রাচীন ইহুদি কল্পকাহিনীতে লিলিথকে বিবেচনা করা হয় ভয়ানক এক পিশাচী ও শয়তান হিসেবে। সেখান থেকে লিলিথ জায়গা করে নিয়েছে ধর্মগ্রন্থে। তাকে বিবেচনা করা হয়েছে প্রথম মানবী হিসেবে যে কিনা আদমের সঙ্গ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আবার কোনো কাহিনীতে শোনা যায়, লিলিথ গোপনে সদ্যজাত শিশুদের ঘর থেকে চুরি করতেন এবং যুবক পুরুষদের প্ররোচিত করেতেন রাতের নির্জনে। দিন এবং রাতের মধ্যে কিছু প্রতীকী অর্থ প্রাচীন কাল থেকেই চালু রয়েছে। রাতকে ধরা হয় অন্ধকার ও অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে। সেইদিক থেকে লিলিথ হচ্ছে অন্ধকারের নারী। আধুনিক সময়ে এসে অনেকে লিলিথকে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। অর্থাৎ লিলিথ সাম্যতায় বিশ্বাস করতেন। বৈষম্যের প্রতিবাদ করতে গিয়েই তিনি হলেন বিদ্রোহী। অন্ধকারে নির্বাসিত জীবন যাপনের কারণেই তিনি হলেন রহস্যময়ী।

লিলিথ উপাখ্যানের উৎপত্তি হয়েছিল যীশু খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন সুমেরীয় রূপকথায়। তাকে বলা হত ‘অন্ধকারের নারী’ বা ডাইনি, যে কিনা বনে বাদাড়ে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াত। এই রূপকথায় লিলিথ ছিল তেপান্তরের ভয়ংকর এক অশুভ আত্মা। লিলিথের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর একটি খোদাই করা সিরীয় লিপিতে। সেখানে লেখা ছিল, ‘হে অন্ধকারের উড়ন্ত অশুভ আত্মা, দূর হয়ে যা এই মুহূর্তে, হে লিলি!’

পরবর্তীতে লিলিথ জায়গা করে নেয় ইহুদি ব্যাবিলনীয় তালমুদে। সেখানে লিলিথের যে উল্লেখ রয়েছে তা থেকে অনেকে লিলিথকে মনে করতো রাতজাগা প্যাঁচা, আবার অনেকে মনে করতো শয়তান। এই কাহিনীতে লিলিথ শুধু একটা অশুভ আত্মাই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন অনিয়ন্ত্রিত যৌনতার প্রতীক। ব্যাবিলনীয় তালমুদে (শাবাত ১৫১এ) বলা আছে, ‘কোনো যুবক পুরুষের জন্য রাতের বেলায় ঘরে একা একা ঘুমানো নিষিদ্ধ। কারণ লিলিথ তাকে ছলে বলে গ্রাস করবে।’ বলা হত, লিলিথ নাকি একলা পুরুষের বীর্যে নিজেকে গর্ভবতী করে আরও শয়তানের জন্ম দিবে।

এই ধরনের কল্পকাহিনীর পর এলো একটু যুক্তিসঙ্গত ভাবে লিলিথের গল্পকে ব্যাখ্যার একটা চেষ্টা। ইহুদিদের ‘দ্যা বুক অব জেনেসিসে’ বর্ণিত অনেক জটিলতাকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য করার চেষ্টা চালাতো মিদ্রাশ সাহিত্য। ধর্মগ্রন্থকে সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার একটা চেষ্টা মাত্র যাতে মানুষ বুঝতে পারে। জেনেসিসের মিদ্রাশ সংস্করণে (জেনেসিস রাব্বাহ) লিলিথকে রূপ দেয়া হয়েছিল অশুভ আত্মা থেকে একটা গ্রহণযোগ্য চরিত্রে। এখানে দাবি করা হয়, ইভেরও আগে আদমের প্রথম স্ত্রী ছিল লিলিথ। জেনেসিসে বর্ণিত দুইটি সৃষ্টি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে এই ব্যাখ্যা দেয়া হয়। জেনেসিস-১ এ বলা আছে, নারী এবং পুরুষ উভয়ই একইসময়ে তৈরি। কিন্তু জেনেসিস-২ এ বলা আছে, ইভের আগে তৈরি হয় আদম। জেনেসিসের মিদ্রাশ সংস্করণে বলা হয়, আদি সৃষ্টির এই দুই গল্প আসলে ভিন্ন। প্রথম গল্পে আদমের স্ত্রীকে একই সময়ে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় সমানভাবে। কিন্তু কোনো একটা কারণে তাদের সেই বিয়ে টেকেনি। কাজেই সৃষ্টিকর্তা আদমের জন্য আবার তৈরি করলেন দ্বিতীয় স্ত্রী ইভকে।

নবম এবং দশম শতাব্দীর দিকে লিলিথ বিষয়ক এই জাতীয় ভিন্ন ভিন্ন রূপকথা সংগ্রহ করা হল। সংগ্রহের নাম দেয়া হলো, ‘অ্যালফাবেট অব বেন সিরা’। সেখানে ‘আদমের স্ত্রী’ হিসেবে লিলিথ এবং ‘শয়তান’ হিসেবে লিলিথের দুই গল্পের একটা সমন্বয় সাধন করে বড় একটা পূর্ণাঙ্গ গল্প দাঁড় করানো হলো। গল্পটা এইরকম-

আদমের নিঃসঙ্গতার কথা চিন্তা করে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর মাটি দিয়ে তৈরি করলেন লিলিথকে। তিনি হলেন ঠিক আদমের সমান সমান। তাদের দুজনকে যখন একত্রে আনা হল তখন সাথে সাথেই তারা ঝগড়া শুরু করলেন। ঝগড়ার সূত্রপাত শুরু হল সঙ্গমের সময়। আদম লিলিথকে বললেন, তোমাকে আমার নিচে শুতে হবে। কিন্তু লিলিথ বিদ্রোহী হয়ে উল্টো বললেন, না তোমাকে নিচে শুতে হবে। যেহেতু তারা একই উপাদানে সমান ভাবে তৈরি সেহেতু কেউ কারো কথা শুনতে নারাজ।    

পরিস্থিতি যখন আরো খারাপ হলো তখন লিলিথ আর আদমের সাথে থাকলেন না, শুন্যে উড়ে চলে গেলেন। আদম তখন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা শুরু করলেন, ‘হে প্রভু! যে নারীকে তুমি দিয়েছিলে সে চলে গেছে। তাকে ফিরিয়ে দাও।’ আদমের প্রার্থনা শুনে সৃষ্টিকর্তা তখন তিনজন ফেরেশতা পাঠালেন লিলিথকে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং তাদেরকে বলে দিলেন, ‘লিলিথকে ফিরিয়ে নিয়ে আসো। যদি সে সেচ্ছায় আসতে চায়, তাহলেই সে আসবে। যদি না চায় তাহলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোনো অবস্থাতেই আনা যাবে না।’  

তিন ফেরেশতা মিলে খুঁজতে গেলো। তারা লিলিথকে খুঁজে পেল মিশরের সাগরতীরে। লিলিথকে তারা বললো, ‘তুমি যদি আমাদের সাথে সেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি হও তাহলে ভালো। কিন্তু যদি রাজি না হও তাহলে তোমাকে আমরা সাগরে ডুবিয়ে মারবো।’
লিলিথ তখন বললো, ‘দেখ ভাই, আমি জানি সৃষ্টিকর্তা আমাকে তৈরি করেছেন কেবল সদ্যজাত শিশুদের দুর্বল করে দেয়ার জন্য। শিশুর জন্মের দিন থেকে আটদিন বয়স পর্যন্ত তার উপর আমার ক্ষমতা রয়েছে। শিশুটি যদি ছেলে হয় তাহলে আটদিনের পরে তার উপর আমার কোনো ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু শিশুটি যদি মেয়ে হয় তাহলে আমার ক্ষমতা থাকবে বারদিন পর্যন্ত।’     

ফেরেশতারা তখন লিলিথকে বলেন, ‘আমরা তোমাকে যেতে দেব না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি মেনে নেবে যে প্রতিদিন তোমার একশো সন্তান মারা যাবে।’ লিলিথ সেটা মেনে নিয়েছিলেন।

অনেকে বিশ্বাস করেন এই গল্প তৈরি করা হয়েছিল তখনকার সময়ের শিশু মৃত্যুর একটা ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য। আবার অনেকের মতে এটা যৌনতার একটা হাঁসির গল্প যেখানে লিলিথ একজন বিদ্রোহী নারী যে কিনা আদমের অধীনে থাকাটা প্রত্যাখ্যান করেছে। লিলিথের আগের গল্পগুলো যতটা না ইহুদিদের মাঝে ছড়াতে পেরেছিল, এই নতুন গল্প তার চেয়ে দ্রুত বেগে ছড়ালো। লিলিথ বনে গেলো এমন এক চরিত্র যাকে সমস্ত স্বৈরশাসক ভয় পান।

আধুনিক সময়ে লিলিথ উপাখ্যানকে মানুষ ব্যাখ্যা এবং ব্যবহার করেছে নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। অনেক নামকরা কবি সাহিত্যিকেরা লিলিথকে ব্যাখ্যা করেছেন নতুন রূপে। এদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি জনপ্রিয় আধুনিক লিলিথ গল্প বোধ হয় জুডিথ প্লাস্কোর লেখা ‘দ্যা কামিং অব লিলিথ’। এখানে লিলিথের নারীচেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। লিলিথ যে আদমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে স্বাধীনতা চায় সেটাও মুখ্য হয়েছে এই গল্পে। তবে এই গল্পে একটা নতুনত্ব যোগ হয়েছে। এখানে লিলিথ নারী সঙ্গ পছন্দ করে এবং সে গোপনে আদমের স্ত্রী ইভের সাথে বন্ধুত্ব করে এবং একত্রে জ্ঞান অনুসন্ধান করে। স্বর্গে যে সাপ ইভকে প্ররোচিত করেছিল সে হচ্ছে এই ছদ্মবেশী লিলিথ।

মানুষ যেন লিলিথের গল্প বলে শেষ করতে পারছেন না। লিলিথ এমন একটি কাল্পনিক চরিত্র যেখানে নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে অবিরত। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সেই প্রাচীন কাল থেকে ঘুরে ফিরে লিলিথের যতগুলো রূপ চালু রয়েছে এবং নতুন আরো যত আবির্ভূত হচ্ছে, সেখানে লিলিথ সবসময়ই রহস্যময় এবং বিতর্কিত একজন নারী। প্রথমে একজন পিশাচী, তারপর বিদ্রোহী স্ত্রী, ছলনাময়ী এবং আরো কত কি। লিলিথ বরাবরই যেন সাধারণ মানুষের সীমানার বাইরের কেউ একজন। লিলিথ যেন একটা অসংগতি। তিনি যেন দলছুট কোনো অভিমানী নারী। অভিমানী কিন্তু জেদি। লিলিথের যতগুলো রূপ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রূপ হচ্ছে, মাথা অবনত না করার রূপ। লিলিথ আদমের অধীনতাকে অস্বীকার করেছিলেন কারণ যুক্তিতে তিনি আদমের সমান সমান। আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে লিলিথ যেন চিরকালের জন্য সেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন। এই রহস্যময় নারী যেন মানব সভ্যতার আশে পাশে হেঁটে চলেছেন অনন্তকাল ধরে, আর আহত হয়ে দেখছেন পৃথিবীর মানুষ কে কি বলছে তার সম্বন্ধে?



মন্তব্য চালু নেই