প্যারিস, ব্রাসেলসে সরব, তুরস্কের ব্যাপারে নীরব কেন?

মঙ্গলবার তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে এক সন্ত্রাসী হামলায় ৪১ জন নিহত এবং ২৩৯ জন আহত হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে, তা যারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নিয়মিত পাঠক তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে হামলা হয়েছে। চলতি বছর ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসেলসে হামলা করেছে সন্ত্রাসীরা। এছাড়া সর্বশেষ এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোর একটি সমকামী ক্লাবে।

প্যারিস, ব্রাসেলস কিংবা অরল্যান্ডোর ঘটনায় যেভাবে গণমাধ্যমগুলো সরব ছিল তুরস্কের ব্যাপারে ঠিক ততটাই চুপচাপ। এখানে গণমাধ্যমগুলো আলাদা কোনো তদন্তেরও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। অথচ আগের ঘটনাগুলো নিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অনুসন্ধানী সংবাদ প্রচার করে গেছে আন্তর্জাতিক সবগুলো গণমাধ্যম।

শুধু গণমাধ্যই নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘নিরব’ ভূমিকাও এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। ব্রাসলেসের ঘটনার পর সমবেদনা জানাতে তখন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে বেলজিয়ামের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন ডেভিড ক্যামেরন। কিন্তু তুরস্কের ক্ষেত্রে একই উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি। এখন পর্যন্ত তুর্কি জনগণের প্রতি একাত্মতা জানানোর ব্যাপারটি কূটনৈতিক ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ নিয়ে স্বাভাবিক কূটনৈতিক ভাষাতেই কথা বলেছেন সবাই।

তুরস্কের ঘটনার ব্যাপারে এমন ভাসা ভাসা প্রতিক্রিয়ার কারণ কী? ইউরোপের কোনো দেশ বা যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকে নিঃসন্দেহে আরো ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেতো। ব্রাসেলস, অরল্যান্ডোর মতো জায়গায় যখন ঘটনাগুলো ঘটে তখন অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে সারা পৃথিবীর মানুষকে শোক প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়। সমস্ত পশ্চিমা বিশ্ব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

একই ধরনের ঘটনা যখন মুসলিম দেশগুলোতে ঘটে, অথবা বৈরুত, বাগদাদ কিংবা ইস্তাম্বুলে যখন হামলার ঘটনা ঘটে- তখন কি সংবাদ মাধ্যমগুলো পশ্চিমাদেশগুলোর এতটা গুরুত্ব দেয়? তুরস্কের ঘটনায় কেন জেরুজালেমের দেয়াল লাল তুর্কি পতাকায় আচ্ছাদিত হয় না? আঙ্কারায় হামলা হলে কেন সেলিব্রিটি নেতাদের টুইটারে পোস্ট আসে না?

মানবাধিকারের বাণী প্রচার করে বেড়ানো নেতারা আর আমাদের মিডিয়া পণ্ডিতরা আমাদের বুঝাতে সক্ষম হয়: আমাদের (পশ্চিমাদের) সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়ার ঘটনা আসলেই ট্রাজেডি। আর ওদের (আরব এবং তুর্কি) সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও ওদের অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার স্বাভাবিক প্রভাব।

তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে ৪১ জন নিহত আর আড়াইশো আহত হওয়ার কথাই বলুন অথবা শুধু জুন মাসজুড়েই যে ইরাকে ১ হাজার ৮৭ জন মানুষ মরলো তার কথাই বলুন কোনো কিছুতেই আমাদের গা শিউরে ওঠে না। যতটা ওঠে পশ্চিমাদের বেলায়। মনে করা হয়, আরব অথবা মুসলিম বিশ্ব কিংবা তুরস্ক- এদের ভাগ্যের সঙ্গেই সহিংসতা জড়িয়ে আছে।

সন্ত্রাসবাদ দমনে নিঃসন্দেহে সংহতি প্রকাশ প্রয়োজন আছে। একে উৎসাহিতও করা উচিৎ। প্রশ্ন হচ্ছে, একই পন্থা কেন তুরস্ক এবং আরবের ভাইবোনদের ব্যাপারে অনুসরণ করা হবে না?

ভয়াবহ এসব সন্ত্রাসী হামলার ক্ষেত্রে কারো জাতিগত পরিচয়ের ব্যাপারে এ ধরনের একপেশে উপজাতীয় চিন্তাধারা এবং সংবাদের ব্যাপারে উদাসীনতা আমাদের রাজনৈতিক অনুন্নয়নের লক্ষণ। সারা পৃথিবীতেই যখন দিন দিন সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বেড়ে চলেছে এমন পরিস্থিতিতে যদি আমরা বিচ্ছিন্ন থাকি, সমবেদনা জানাতে ব্যর্থ হই তবে সঙ্কটও দিন দিন বেড়েই চলবে। শুধু আইএস নয়; অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠিই মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।



মন্তব্য চালু নেই