পিরামিড কি শস্যভাণ্ডার ছিল?

আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জেন কারসন সম্ভবত বিতর্ক উস্কে দিতে পছন্দ করেন। ‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কোনো মুসলিম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অযোগ্য’- এ কথা বলে তিনি প্রথম আলোচনায় আসেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে একজন মুসলিম বলতেও তিনি কসুর করেননি। এসব অবশ্য সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি ছাড়া আর কিছু নয়। আর গোড়া খ্রিষ্টান চার্চের একজন সদস্য হিসেবে তার এমন বক্তব্য অসম্ভব কিছু না। ভোটের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অনেকেই ধর্মের এমন অস্ত্র ব্যহার করেন। কারসনও এর ব্যতিক্রম না।

এবার একটি ভিন্ন রকমের তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন জেন কারসন। নির্বাচনী প্রার্থীতার প্রচারণায় একটি স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বলেছেন, মিশরের পিরামিড কোনো রাজার সমাধি নয়; বরং এটি ছিল শস্যের ভাণ্ডার বা গোলা। তিনি প্রমাণ হিসেবে ওল্ড টেস্টামেন্টের যোসেফের (ইউসুফ) একটি কাহিনির কথা উল্লেখ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে পাঠ্যবইয়ে পিরামিডগুলো ফারাওদের সমাধি বলেই শিশুদের পড়ানো হয়। নিশ্চিতভাবেই ওই ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা তার কথা শুনে একে-অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছে।

কারসনের এ তত্ত্ব অবশ্য নতুন কিছু নয়। তিনি এর আগেও একটি ধর্মীয় স্কুলে বক্তৃতাকালে এমন তত্ত্বের প্রতি তার বিশ্বাসের কথা বলেছেন। গত বুধবার বাজফিড নামে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম কারসনের ১৭ বছর আগের একটি ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে। ওই সময় মিশিগান ইউনিভার্সিটির অধীনে সেভেন্থ-ডে অ্যাডভেন্টিস্ট চার্চে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে দেওয়া এক বক্তৃতায় নিউরোসার্জন কারসন বলেন, পিরামিডগুলো কোনো এলিয়েনও তৈরি করেনি বা এগুলো ফারাওদের সমাধিও নয়। যোসেফের পরামর্শে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ফারাও শস্যভাণ্ডার হিসেবে এসব পিরামিড নির্মাণ করেন।

তিনি বলেন, এখন অনেক পুরাতত্ত্ববিদ বলে থাকেন, পিরামিডগুলো ফারাওদের সমাধি। কিন্তু তোমরা যদি গভীরভাবে ভাবো তবে বুঝতে পারবে পুরাতত্ত্ববিদদের দাবি কতটা বিভৎস। এর ভেতরের খোপগুলো এমনভাবে আবদ্ধ, যা নিরাপদে গম রাখার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।’

কী আছে কারসনের পিরামিড-তত্ত্বে? ওল্ড টেস্টামেন্টের ওই আখ্যানে বলা হয়েছে যোসেফ ছিলেন জেকবের (ইয়াকুব) ১২ ছেলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তার অন্য ভাইয়েরা ঈর্ষান্বিত হয়ে যোসেফকে একটি কূপের মধ্যে ফেলে দেয়। বাড়িতে এসে বাবাকে জানায় ছোটভাইকে নেকড়ে খেয়ে ফেলেছে। ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল একদল বণিক। তারা যোসেফকে কূয়া থেকে উঠিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়। তার চেহারা-ছবি ভালো থাকায় ফারাওয়ের এক রাজকর্মচারীর কাছে দাস হিসেবে চড়া দামে বিক্রি করে দেয় যোসেফকে। নানা ঘটনার পর এক সময় ফারাওয়ের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন তিনি। একদিন ফারাওয়ের এক স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে যোসেফ বলেন, এ বছর দেশটিতে প্রচুর শস্য ফলবে, কিন্তু সামনের বছর দেখা দেবে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় শস্যের গোলা নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয় রাজাকে। এভাবে গোলা তৈরি করে শস্য মজুদ রেখে মিশরবাসীকে বড় ধরনের দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন যোসেফ।

কারসন জানাচ্ছন, পিরামিডের নির্মাণশৈলী এবং এর নানা ধাপ থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, এগুলো ছিল মূলত শস্যভাণ্ডার। কারণ এসব পিরামিড শস্য মজুদ রাখার জন্যই উপযুক্ত। অনেক বছর পরে রাজারা এগুলোকে নিজেদের সমাধি হিসেবে ব্যবহার করেন।

অবশ্য গোড়া খ্রিষ্টান কারসনের এ তত্ত্ব কোনো নতুন বিষয় নয়। অনেকদিন থেকেই এ ধারণা অনেক খ্রিষ্টানের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তাছাড়া ইউরোপে মধ্যযুগ থেকেই পণ্ডিতদের মধ্যে এ বিশ্বাস বধ্যমূল ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিশরীয় পুরাতত্ত্বের প্রফেসর জন ডার্নেল বলেন, মধ্যযুগ থেকেই ইউরোপের খ্রিষ্টান পন্ডিতদের মধ্যে এ ধারণা প্রথম দানা বাঁধে। তারাই প্রথম প্রচার করেন পিরামিডগুলো আসলে শস্যভাণ্ডারই ছিল। ভেনিসের সেন্ট মার্কস ক্যাথেড্রালে কিছু দেওয়ালচিত্র অঙ্কিত আছে। সেখানে মিশরের গিজার তিনটি পিরামিডের ছবি রয়েছে। ওই চিত্রগুলো বাইবেলে যোসেফের কাহিনি অবলম্বনে অঙ্কিত। সেখানে পিরামিডগুলোকে শস্যভাণ্ডার হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে।

তবে শস্যভাণ্ডার তত্ত্ব বেশি জনপ্রিয় হয় ষষ্ঠ শতকের ফ্রাঙ্কিশ বিশপ সেন্ট গ্রেগরি অব টুরস এর লেখায়। তিনি বলেছেন, পিরামিডগুলোর নিচের অংশ খুব প্রশস্ত আর ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে চিকন হতে শুরু করেছে। কারণ গম রাখা এবং তা বাইরে নিয়ে আসার জন্য তা ছিল উপযুক্ত। এখনকার গোলাগুলোও একই আকৃতিতে নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এতেই প্রমাণ হয় সেগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে শস্যভাণ্ডার।

চতুর্দশ শতকের পরিবাজ্রক জন মেন্ডেভিলে তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, যোসেফের সময়ই গম রাখার জন্য পিরামিডগুলো তৈরি হয়েছিল।

অবশ্য পুরাতত্ত্ববিদ ডারনেল বলেছেন, মধ্যযুগে গোলাতত্ত্বের ধারণা জন্ম নিলেও রেনেসাঁসের সময় থেকে মানুষের মনে এ বিশ্বাস অনেকটা ফিকে হতে শুরু করে। কারণ পিরামিড নিয়ে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ও বিস্তারিত গবেষণার শুরু তখন থেকেই। ফলে মানুষ আর পুরনো চিন্তায় মনোনিবেশ করেনি। ১৯২২ সালে ফারাও তুতেনখামেনের মমি আবিষ্কার এবং পিরামিডের ভেতরের প্রাচীন মিশরীয় রাজাদের ব্যবহার্য নানা নিদর্শন খুঁজে পাওয়ার পর পুরোপুরিভাবে এটা প্রমাণিত যে এসব ফারাওদের সমাধিই ছিল। তা ছাড়া প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যোসেফের সময়ের কয়েক শতক পরে পিরামিডগুলো নির্মিত হয়েছে।

জেমস অ্যালে নামে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির আরেক মিশরীয় পুরাতত্ত্ববিদ বলেছেন, শস্য রাখার জন্য এমন বড় স্থাপনা নির্মাণের কোনো কারণই নেই। এটা সম্পূর্ণ অবাস্তব। এক সময় টাওয়ার অব লন্ডনকেও এমনটা ভাবা হতো।

অবশ্য কারসনের দাবি শুধু প্রত্নতাত্ত্বিকরাই বাতিল করে দেননি। অনেক রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ একে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের মতে পিরামিড নিয়ে কার্সনের এমন দাবি হয় মূর্খতা, না হয় রাজনৈতিক চালবাজি।

তথ্যসূত্র : বিবিসি, সিবিএস ও বাজফিড।



মন্তব্য চালু নেই