পশ্চিমবঙ্গে একুশের আবেগ নেই কেন?

বাংলাদেশে একুশের প্রথম প্রহর রাত বারোটা থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সারাদেশের শহীদ বেদীতে চলে শ্রদ্ধা নিবেদন।

আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার এ দিনটি বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে স্মরণ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কিভাবে পালন করে দিনটি?

কলকাতার সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত একাডেমি-নন্দন-রবীন্দ্র সদন চত্বরের কাছে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছে প্রায় কয়েক দশক ধরে। সেখানে রাতভর গান হয়, কবিতার আসর বসে, আর সেটা শেষ হয় প্রভাতফেরীর মধ্য দিয়ে।

সরকারি অনুষ্ঠান ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি স্কুল কলেজে কিছুদিন ধরে `একুশে ফেব্রুয়ারি` উদযাপন শুরু হলেও সেখানকার সাধারণ মানুষের মনে যে দিনটি নিয়ে কোনও ভাবনা কাজ করে না সেকথাও অকপটে স্বীকার করেন অনেকে।

বহু বছর ধরে একাডেমি- নন্দন-রবীন্দ্র সদন চত্বরে অনুষ্ঠানটি যারা পরিচালনা করেন, সেই ভাষা ও চেতনা সমিতির প্রধান এমানুল হক বলছিলেন, এপারের বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে একটা ভাবনা কাজ করে যে আমরা ভাল করে ইংরেজি শিখতে পারিনি বলে জাতি হিসেবে উন্নতি করতে পারিনি।

তাই সকলেই সেদিকে ছুটেছে, নিজের ভাষার প্রতি খুব একটা খেয়াল কখনোই করিনি আমরা। বাংলা ভাষাটা এখন আর আবেগ নয়, একটা অর্থনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তারা একাই একুশের অনুষ্ঠান করে আসছেন, তবে একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে অনুষ্ঠানের সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বহু স্কুল, কলেজ বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে এখন একুশের অনুষ্ঠান হয়।

যেমন, এ বছর থেকেই ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বেলঘরিয়া হাই স্কুল।

সেখানকার প্রধান শিক্ষক মনোজ কুমার সিং নিজে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাই কয়েক মাস আগে স্কুলের দায়িত্ব পেয়েই নিজের আবেগের দিনটা পালনের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

‘আমার নিজের ভালো লাগাটা চেষ্টা করছি ছাত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে, সেজন্যই একুশের অনুষ্ঠান শুরু করলাম।’

‘ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভাষা আন্দোলন নিয়ে যে আবেগ নেই, সেটার জন্য ওদের খুব একটা দোষ নেই। সবাই তো ইঁদুর দৌড়ে নেমে পড়তে বাধ্য হয়েছে। সেই দৌঁড়ে জিততে হলে ইংরেজি বা হিন্দির গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশী’- বলছিলেন বেলঘরিয়া হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিং।

এই পশ্চিমবঙ্গেই ক্ষমতায় এসে বামফ্রন্ট ইংরেজি তুলে দিয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রচলন ঘটিয়েছিল। তাহলে পশ্চিমবঙ্গে কেন নিজের ভাষা নিয়ে আবেগ তৈরি হলো না?

সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার যে কষ্টটা ওপার বাংলার মানুষ বা আসামের বরাক উপত্যকার মানুষ পেয়েছেন, সেটা তো পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে পেতে হয়নি।

নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারার মতো কোনও অবস্থা আমাদের কখনো হয়নি, সেজন্যই ওখানে যে আবেগ রয়েছে ভাষা নিয়ে বা একুশে নিয়ে, সেটা যে আমাদের মধ্যে থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক- বলেন দিব্যেন্দু পালিত।

তবে পশ্চিমবঙ্গে যে একুশে উদযাপনের সংখ্যাটা বাড়ছে, সেটা একদিকে যেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, একই সঙ্গে সেটা কিছুটা প্রথামাফিক দিবস উদযাপনের মতো হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।

শিক্ষাবিদ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ীর মতে, এটা খুবই ভালো যে মুখ্যমন্ত্রী নিজে একবার একুশের সরকারি অনুষ্ঠানে যান। স্কুল-কলেজগুলোতেও আজকাল ভাষা দিবস পালিত হচ্ছে।

তবে সেটা অনেকটা ব্রতপালনের মতো – করতে হয় তাই করা হচ্ছে। তার মধ্যে আবেগ খুব একটা থাকে না, আর সেটা স্বাভাবিকও। কারণ বাংলাদেশের মানুষদের নিজেদের ভাষার জন্য যে লড়াই করতে হয়েছে, আমাদের তো সেটা করতে হয়নি। বড়জোড় সেই লড়াইয়ের সহমর্মী বা সমব্যথী হয়ে থেকেছি।

ভাষা শহীদ দিবস নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সেরকম আবেগ না থাকলেও সামাজিক মাধ্যমে কিন্তু বহু পশ্চিমবঙ্গবাসী আজকের দিনে ব্যাপকহারে পোস্ট বা পোস্টার শেয়ার করেন।

আবার অনেকে এই কটাক্ষও করেন যে শুধু একদিন ভাষার প্রতি নিজের আবেগ আর ভালবাসা জাহির না করে বছরজুড়ে সেটা করা উচিত। বিবিসি বাংলা।



মন্তব্য চালু নেই