‘দয়া করে আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না’

মালয়েশিয়া যাওয়া উদ্দেশ্যে সাগর পাড়ি দেয়া প্রায় ৯০০ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি নাগরিক এখন ইন্দোনেশিয়ার একটি অস্থায়ী শিবিরে আছেন। এদের বহনকারী নৌকাটি সাগরে ডুবে গেলে স্থানীয় জেলেরা তাদের উদ্ধার করে। প্রায় তিন মাস সাগরে ভেসে জীবনের কঠিন বাস্তবতা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছেন তারা।

নৌকায় এদের অনেক সহযাত্রী না খেয়ে ও পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে। বেঁচে গেলেও তারা ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে। এতসব কঠিন বাস্তবতা সত্বেও অনেকে বলছেন, তারা কোনভাবেই আর দেশে ফিরতে চান না। দেশের সব সহায় সম্বল বিক্রি করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন তারা। দেশে ফিরে তাদের আর কিছুই করার নেই। তাই যেকোনভাবেই হোক, মালয়েশিয়া যেতে চান।

১৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী উমাই সোমাদিয়া এবং তার ছোট দুই বোন যাদের বয়স ১৩ ও ১১, সিদ্ধান্ত নেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে নির্মান শিল্পে কর্মরত তাদের বড় দুই ভাইয়ের কাছে যাবেন। সেখানে গিয়ে কোনরকমে একটা কাজ জুটিয়ে জীবনধারণ করবেন। এদের এক ভাই গত সাত বছর ধরে এবং অন্যজন গত পাঁচ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় কর্মরত আছে।

তিন বোন মিলে এ সিদ্ধান্ত নেন ২০১২ সালে, মিয়ানমারের মংডুতে তাদের বাবা-মাকে হত্যা করার পর।

কিন্তু ভাগ্যের তাড়া খেয়ে তাদের স্থান হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের একটি অস্তায়ী শরণার্থী শিবিরে। গত বৃহস্পতিবার ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের কাছ থেকে প্রায় ৬০০ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা নাগরিকদের সাথে এ তিন বোনকেও উদ্ধার করা হয়।

এ শিবিরেই ২০১২ সালের বিভিীষিকাময় রাতের কথা স্মরণ করছিলে উমাই সোমাইদা।

’তারা রাতের আঁধারে আমাদের উপর আক্রমণ করলো। আমরা আক্রমণ থেকে বাঁচতে পালিয়ে রইলাম। কিন্তু তারা আমার বাবা-মার গলা চেপে ধরলো। তাদেরকে খুন করলো।

২০১২ সাল থেকে উমাই সোমাদিয়ার ভাইয়েরা তাদেরকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ জমাচ্ছিলো। শেষে প্রায় ২ হাজার ডলারের বিনিময়ে তারা মালয়েশিয়া যাত্রা শুরু করেন।

উমাই বলেন, দয়া করে আমাদের ফিরিয়ে দিবেন না, আমরা মালয়েশিয়া যেতে চাই। আমার ভাইদের কাছে যেতে চাই। আমরা এই অচেহতেও থাকতে চাই না।

এখন এ শরণার্থী শিবিরে থেকেও, গত তিন মাস সাগরে কঠিন বাস্তবতার কথা স্মরণ করেও মালয়েশিয়া যেতে চান তারা। শুধু তারাই নয়, এখনো শিবিরের অনেকেই মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী।

যদিও এখন মালয়েশিয়া এসব অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। দেশটি সরাসরি নিষেধ করে বলেছে, তারা আর এসব অবৈধ অভিবাসীর ভার বইতে পারবে না।

জাকার্তায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরতে পারবে না। মিয়ানমার তাদেরকে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। তাই জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার উদ্যোগে এ ইন্দোনেশিয়াতে তাদের জন্য অস্থায়ীভাবে থাকার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

তবে সে তুলনায় বাংলাদেশিরা ভালো অবস্থায় আছে। ইন্দোনেশিয়া নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো: নাজমুল কুনাইন তদাদের জাতীয়তা নিশ্চিত হওয়া পর দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাবস্থা করছেন। কিন্তু তবুও মুহম্মদ সিয়াফিল্লাহ সালিমের (৩৬) মত অনেকেই দেশে ফিরতে রাজি নয়।

সালিম একটি মসজিদের ইমাম হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে প্রায় এগারো হাজার টাকা বেতন পেতেন তিনি। কিন্তু আরেকটু উন্নত জীবনের আশায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ছেড়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।

মায়ের জমি বিক্রি করা টাকা এবং শ্বশুরের সাহায্য মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার ডলারের বিনিময়ে মালয়েশিয়াগামী নৌকায় উঠেছিলেন তিনি। আর্তি করে বলছিলে, আমরা গরিব মানুষ। কোন টাকা আর অবশিষ্ট নেই। বাড়িতে গিয়ে কি করবো?

তবে ভিন্ন ইচ্ছার মানুষও আছে। যেমন শুকতারা(২৪)। চার বয়সী একটি বাচ্চা আছে তার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর সাগর পাড়ি দিতে চান না তিনি। বরং আচেহ বা অন্য যেখানেই হোক, নিরাপদে তাকতে চান্ তিনি। বলছিলেন, আমার স্বামী বলেছে, ঝুঁকি নিয়ে আর যেন সাগর পাড়ি না দিই। বরং তার চেয়ে আচেহতে থেকে যাওয়া আরো নিরাপদ। আমার স্বামীও আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে।



মন্তব্য চালু নেই