দালালদের খপ্পরে খাবি খাচ্ছে মালয়েশিয়ায় ঢাকা দূতাবাস, দায়িত্বে আ’লীগ-যুবলীগ!
দালালদের খপ্পরে খাবি খাচ্ছে কুয়ালালামপুরের ঢাকা দূতাবাস। সেখানে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেদের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ আর ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হিসেবে দাবি করলেও দালালিই তাদের পেশা বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। দূতাবাসের কিছু অসাধু কর্মচারীদের যোগসাজসে তারা বেপরোয়া প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আর দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম নিজেই বলছেন, কমিউনিটির লোকজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা আমাদের সাহায্য করছেন।
কার্যত মালয়েশিয়ায় এখন বিদেশি শ্রমিকদের পুন: নিবন্ধন চলছে। অনেক অবৈধ শ্রমিকই পুনঃ নিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছেন। এর ফলে পাসপোর্ট ছাড়া শ্রমিকরাও পাসপোর্ট করার সুযোগ নিচ্ছেন। দূতাবাসে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট এবং নবায়ন করার জন্যে ভিড় করছেন অভিবাসীরা। এদের মধ্যে শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি।
গড়ে প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ হাজার পাসপোর্ট নবায়নের কাজ করা হচ্ছে বলে জানান শহীদুল ইসলাম।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় কুয়ালালামপুরে ঢাকা দূতাবাস ঘুরে দালালদের আধিপত্য চোখে পড়ে। পাসপোর্টের ফরম পূরণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট ফেরত পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই রয়েছে দালালদের হয়রানি। তবে দূতাবাস থেকে বলা হচ্ছে, লোকবল সংকটের কথা।
দালালদের বিষয়ে আমাদের কাছে রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামের বক্তব্য, কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
পেনাংয়ের একটি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে চাকরি করেন সোলায়মান। তিনি বলেন, এখানে পাসপোর্টের ফরম পূরণের জন্যে নেয়া হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ রিঙ্গিত (৩ থেকে ৪ হাজার টাকা) পর্যন্ত। এর মধ্যে ব্যাংকের টাকাও জমা দেয়ার কাজটি করে দিচ্ছেন দালালরা। আবার ব্যাংকের টাকা নিজেরা জমা দিলে শুধু ফরম পূরণের জন্যে নেয়া হচ্ছে ১০ থেকে ২০ রিঙ্গিত (২০০ থেকে ৪০০ টাকা)। শ্রমিকদের অজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন দালালরা। আর নিজেদের তারা পরিচয় দিচ্ছেন দূতাবাসের সেচ্ছাসেবক হিসেবে।
সোলায়মান বলেন, পাসপোর্টের জন্য একজন শ্রমিককে মোট তিনবার আসতে হচ্ছে। প্রথম দিনে এসে ব্যাংকের টাকা জমা দিয়ে রিসিট নিয়ে যাওয়া, দ্বিতীয় দিনে এসে ছবি তোলা ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়া এবং তৃতীয় দিনে এসে পাসপোর্ট সংগ্রহ। পুলিশ এখন জানে, এই দূতাবাসে যারা আসছেন, তাদের কাগজপত্রের সমস্যা রয়েছে। ফলে তারাও ওঁত পেতে থাকেন। প্রতিদিনই বাংলাদেশি শ্রমিকরা দূতাবাসে আসার পথে বা যাওয়ার পথে আটক হচ্ছেন।
মালাক্কা থেকে দূতাবাসে আসা শ্রমিক রুহুল আমিন বলেন, যদি একদিন কমিয়ে দুদিনেও পাসপোর্ট হাতে দেয়া যায়, আমরা এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাই। আর এখানে আসার পর জানতে পারলাম, মে ব্যাংক’এর যে কোন শাখাতেই টাকা জমা দিয়ে আসা যায়। অথচ এই তথ্যটি আমরা আগে থেকে জানতে পারলে, এখানে এসে আবার ব্যাংক খুঁজতাম না। অথবা এখানেও টাকা জমা দেয়ার একটি বুথ খোলা গেলে সবচেয়ে ভাল হয়।
আরেকজন শ্রমিক আনোয়ারুল কবির অভিযোগ করে বলেন, এখানে দালালরা সবাই নিজেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা ছাত্রলীগের পরিচয় দিচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে তারা কারা আমরা জানি না। কিন্তু অনেকেই দাবি করছেন, তাদেরকে দূতাবাস থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ শ্রমিকরা তাদের কথায় প্রতারিত হচ্ছেন।
দূতাবাসের সামনের পথে আগে হকার ছিল। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের দূতাবাসের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এখন সেই হকারদের দূতাবাসের ভেতরেই বসার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এই হকারদের কাছ থেকে প্রতিদিনই চাঁদা নিচ্ছেন দূতাবাসের কর্মচারীরা।
এরই মধ্যে দালালদের মধ্যে শুরু হয়েছে গ্রুপিং। একদল আরেক দলকে দোষারোপ করছেন।
দূতাবাসের সামনেই সকাল থেকে দুটি গাড়ি দেখা যায়। এসব গাড়িতেই রয়েছে ভ্রাম্যমাণ প্রিন্টার। সেখানেই এক শ্রেণির দালাল পাসপোর্টের ফরম পূরণ করে মানুষকে দিচ্ছেন। এই দালালদের সঙ্গে সরাসরি দূতাবাসের কর্মচারীরা জড়িত। সূত্র জানায়, এই প্রক্রিয়ায় কর্মচারীরা সরাসরি জড়িয়ে পড়ায় ক্ষুদ্র দালালরা ভীষন ক্ষুব্ধ।
কমিউনিটির নেতা এবং কুয়ালালামপুরে আওয়ামী লীগের যুগ্ন আহ্বায়ক হিসেবে দাবি করা রাশেদ বাদল নিজেও বেশ ক্ষুব্ধ দূতাবাসের ওপর। তিনি বলেন, এখন রি-হায়ারিংয়ের কারণে দূতাবাসে পাসপোর্ট তৈরির চাপ অনেক বেশি। আমরা দল থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা করছি। পেছনের সুইমিং পুলটি পরিষ্কার করে দিয়েছি। ইতিমধ্যে ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্যে ৬টি মেশিন আনা হয়েছে।
তবে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত একটি মেশিনও চালু হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
দূতাবাসের কাজে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ নামধারীদের সহযোগিতার নামে দালালির অভিযোগ বেশ পুরনো। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, দেশের বাইরে কোন শাখা নেই সরকার পরিচালনাকারী এই দলটির।
সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, দূতাবাসে বিজ্ঞাপন দিয়েছে মোবাইল কোম্পানি হটলিংক। এই কোম্পানির বিজ্ঞাপন সম্বলিত সামিয়ানা টানা হয়েছে। দূতাবাসের পেছনের সুইমিং পুলটি পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন তার চারপাশেও আশ্রয় নিতে পারছেন শ্রমিকরা। দূতাবাসের পেছন দিকে দেখা যায়, ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্যে দীর্ঘ লাইন। অনেকেরই অভিযোগ, দালাল বা কর্মচারীদের হাতে ১০ বা ২০ রিঙ্গিত গুঁজে দিলে দ্রুত কাজ হয়ে যায়। না হলে সকালে এসে বিকেলেও শেষ হয় না কাজ।
মালয়েশিয়ায় অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থ্যা ক্যারাম এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হারুন আর রশিদ বলেন, এখানে বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়ার শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি। নেপালের শ্রমিকদের সংখ্যা অনেক। কিন্তু এসব শ্রমিকের তাদের দেশের দূতাবাসের বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ শোনা যায় না। যতোটা বাংলাদেশের শ্রমিকদের হয়রানির কথা শোনা যায়। অবশ্যই শ্রমিকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে পাসপোর্ট কিভাবে আরো সহজতর করা যায়, সে বিষয়ে দূতাবাসের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এসব বিষয়ে কুয়ালালামপুরে ঢাকা দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম বলেন, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ঢাকা থেকে অতিরিক্ত লোক নিয়ে আসা হয়েছে। তারাও পুরনোদের সঙ্গে কাজ করছেন। এছাড়াও নতুন মেশিন আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এখানে সরকারের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছি। কিভাবে আমাদের লোকদের এখানে রাখা যায় এবং নতুন লোক আনা যায়। তবে যারা পুনঃনিবন্ধন করছেন, এরা সবাই এখানে থাকতে পারবেন না। তাদের দেশে ফিরে যেতে হবে। বাংলানিউজ
মন্তব্য চালু নেই