কলারোয়া পৌর নির্বাচনে ভোটারদের মনে ‘যদি’, ‘তবে’

ত্রি-মুখি নাকি দ্বি-মুখি লড়াইয়ে মেয়র প্রার্থীরা?

চুলচেরা হিসাব-নিকাশে শেষ মুহুর্তের নির্বাচনী প্রচারণায় মহাব্যস্ত সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভা নির্বাচনের প্রার্থী ও সমর্থকরা। ৯টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীদের পাশাপাশি মূলত মেয়র প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নিয়ে ভোটারদের নানান বিশ্লেষন চলছে প্রায় সর্বত্র। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে ঘিরে পৌর সদরে বিরাজ করছে উৎসব, আমেজ আর আনন্দ। বিপরীতে রয়েছে নানান শংকাও।

৪ মেয়র প্রার্থী, ২৫ সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী ও ৫ সংরক্ষিত আসনের মহিলা প্রার্থীরা ঘরোয়া বৈঠক, মতবিনিময়, গণসংযোগ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কাছে টানার প্রাণবন্ত চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ছেয়ে গেছে পোস্টার, ব্যানার আর হ্যান্ড পতাকায়। মাইকের প্রচারনায় মুখোরিত পাড়া-মহল্লা। প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি তাদের আত্মীয়-স্বজনও নির্ঘুম ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন প্রচারণায়, যেন এতটুকু সময়ের ফুলছুরত নেই।

১৫.০৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কলারোয়া পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে ১৮ হাজার ৫’শ ২৫ জন ভোটাররা নির্বাচিত করবেন মেয়র ও কাউন্সিলরদের। এ নির্বাচনে নারী ভোটার সংখ্যা ৯ হাজার ৪’শ ২১ জন এবং পুরুষ ভোটার সংখ্যা ৯ হাজার ১’শ ৪ জন। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও র্দীঘ ২০ বছর পর ২০১১ সালে জানুয়ারী মাসে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে পৌরসভাটি ২য় শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে বর্তমানে ৩৩ হাজার ৬’শ ৩৬ জন জনসংখ্যা রয়েছে।

এ পৌরসভাটির দ্বিতীয় নির্বাচনকে সমানে রেখে চার মেয়র প্রার্থী আওয়ামীলীগ মনোনীত দলের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু (নৌকা প্রতীক), বিএনপি মনোনীত দলের উপজেলা ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও পৌর সভার নির্বাচিত প্রথম মেয়র গাজী আক্তারুল ইসলাম (ধানের শীষ প্রতীক), জাতীয়পার্টি মনোনীত দলের উপজেলা সভাপতি মুনছুর আলী (লাঙ্গল প্রতীক) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী কলারোয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আরাফাত হোসেন (মোবাইল ফোন প্রতীক) মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন নিজেদের জয়ী করতে।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকায় গেলে সাধারণ ভোটাররা জানান, মেয়র পদে মূলত আ.লীগের আমিনুল ইসলাম লাল্টু, বিএনপির আক্তারুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র আরাফাত হোসেনের মধ্যে ত্রি-মুখি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নানান হিসাব-নিকাশে মুখরিত পাড়ামহল্লার প্রতিটি মোড় ও প্রায় সকলের মাঝে। ত্রি-মুখি লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত দ্বি-মুখি হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতাও স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে বিএনপির আক্তারুল ইসলামের সাথে আ.লীগের আমিনুল ইসলাম লাল্টু কিংবা স্বতন্ত্র আরাফাত হোসেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে আঞ্চলিকতার প্রভাবও ফেলে দেয়া যায় না। মেয়র প্রার্থী আক্তারুল, আরাফাত ও মুনছুর তিনজনই পৌরসভার ৩নং গদখালী ওয়ার্ডের ভোটার ও বাসিন্দা। অপর প্রার্থী আমিনুল ইসলাম লাল্টু মুরারীকাটির বাসিন্দা ও ভোটার।

নির্বাচনী পর্যালোচনায় বিশেষভাবে উল্লেখিত বাক্য ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’ সূত্র জানিয়েছে, পৌরসভায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সমর্থক ও ভোটার সংখ্যা তুলনামূলক বেশী হওয়ায় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে রয়েছেন বিএনপির প্রার্থী আক্তারুল ইসলাম। দলীয় ও ব্যক্তিগত ইমেজে তরুণ এ নেতা এগিয়ে থাকলেও পুনরায় মেয়রের চেয়ার নিশ্চিত করাটা এবার তার জন্য খুব সহজ নাও হতে পারে। কৌশলগত কারণে বিএনপি’র সাধারণ নেতা-কর্মীরা সরাসারি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ না নিলেও আত্মীয়-স্বজন ও সমর্থকদের নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আক্তারুল ইসলাম। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত হলে গতবারের মতো এবারো নিরব ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে তার জয় তরান্বিত হবে। তবে নানান শংকায় জর্জরিত তার কর্মী-সমর্থকরা প্রকাশ্য মাঠে নামতে না পারায় পরাজয়ের আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। অতিসম্প্রতি তার কয়েকজন কর্মী-সমর্থককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার আতংক ও নানান হয়রানির শংকায় অনেকে ত্রাসে আছেন। পাশাপাশি অনেক ভোটার কারাগারে ও এলাকার বাইরে অবস্থান করায় বিএনপির এ প্রার্থীর ভোট অনেকটা হ্রাস পাবে। তাছাড়া মেয়রের দায়িত্বে থাকাকালীন বিভিন্ন কারণে ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটতেও পারে নির্বাচনে। এছাড়া পৌর বিএনপির একটি অংশ প্রকাশ্য ও গোপনে তার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় সেখানেও ভোট কমতে পারে। এসকল দিক থেকে তার জয়ী হওয়াটা কঠিন হলেও দলীয় প্রতীকের বদৌলত ও জাতীয়-স্থানীয় রাজনীতির প্রভাবেও ইতিবাচক ফলাফল দৃশ্যমান হতে পারে।

নির্বাচনে জয়ী হতে কোমর বেঁধে নেমেছেন আ.লীগ মনোনীত প্রার্থী আমিনুল ইসলাম লাল্টুও। মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন দুই বার নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের সাবেক এ ভাইস চেয়ারম্যান। পারিবারিক ঐতিহ্য, ব্যক্তি ইমেজ, নিজের রাজনৈতিক সাংগঠনিক দৃঢ়তা, আঞ্চলিক প্রভাব ও কর্মী সমর্থনে জয়ী হওয়ার দৌড় গোড়ায় উপজেলা আ.লীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু। অন্তর্দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ইতোমধ্যে উপজেলা আ.লীগের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহম্মেদ স্বপনসহ শীর্ষ স্থানীয় নেতা-কর্মীরা তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। গত নির্বাচনের তুলনায় এবার বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে দলটি। ভোট গ্রহণের শুভক্ষণ পর্যন্ত দলীয় গোপনীয় কোন্দল ও কতিপয় সমর্থকদের বিশ্বাসঘাতকতা এড়ানো গেলে পরবর্তী মেয়র হিসেবে দেখা মিলতে পারে আমিনুল ইসলাম লাল্টুকেই।

পিছিয়ে নেই একমাত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত হোসেনও। গত নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজয়ের পর থেকে দীর্ঘ ৫ বছর নানা ভাবে মাঠ চষেছেন তিনি। জেলা আ.লীগের সাবেক এ সদস্য আ.লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ সাধারণ মানুষের কমবেশি ভোট পেতে পারেন। এমনটি হলে পরবর্তী মেয়রের চেয়ারে কলারোয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আরাফাত হোসেন বসলে আশ্চার্যের কিছুই হবে না। কয়েক বছর যাবত ভোটারদের বাড়িবাড়ি গিয়ে, বিভিন্ন ভাবে তাদের পাশে থেকে ও দান খয়রাত অব্যাহত রেখে নিজের প্রার্থীতা বেশ শক্ত করে নিয়েছেন তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের বিভিন্ন দূর্বলতা আর নিজের সবলতায় আরাফাত হোসেনের সাথেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে অপর দুই প্রার্থী আক্তারুল ইসলাম কিংবা আমিনুল ইসলাম লাল্টুর। তবে পুলিশি সখ্যতাসহ নানান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তার জয় বাধাগ্রস্থ হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।

এদিকে, অনেকটা ঢিলেঢালা ও গা-ছাড়া প্রচারণা চালাচ্ছেন জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী দলটির উপজেলা সভাপতি মুনছুর আলী। নিজের ব্যক্তি ইমেজের বাইরে পৌরসভায় দলীয় ভালো কোন অবস্থান নেই বললেই চলে।

রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ড্রেনসহ পৌরসভার সার্বিক উন্নয়ন, সুপীয় পানীয় জলের ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা দূরীকরণের মাধ্যমে কলারোয়া পৌরসভাকে মডেল ও দূর্ণীতিমুক্ত পৌরসভায় উন্নীত করতে চান সকল মেয়র প্রার্থীরাই। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে চার প্রার্থীই নিজেদের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাধারণ ভোটাররা নিজেদের ভোট প্রয়োগ করতে উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। অনেকের মনে শংকা রয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। ‘যদি’ ও ‘তবে’ এর বিভিন্ন কথামালায় প্রার্থীদের জয়া-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশের বিশ্লেষন করছেন প্রায় সকলে। ভোটারদের রায়ে কে হবেন পরবর্তী মেয়র ও কাউন্সিলর তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে ৩০ ডিসেম্বর বুধবার পর্যন্ত।

ইতোমধ্যে নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন রির্টানিং কর্মকর্তার কার্যালয় উপজেলা নির্বাচন অফিস। নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সাথে শনিবার দিনভর প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময় সভায় অংশ নেন বিভিন্ন কেন্দ্রের দায়িত্ব পালনে নির্ধারিত কর্মকর্তারা।



মন্তব্য চালু নেই