জেলেদের গ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর রাষ্ট্র, কীভাবে? (পর্ব-২)

১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেশটির ক্ষমতায় আসীন হওয়ার দুই বছরের মাথায় ১৯৬৭ সালে হাভার্ড ইউনিভার্সিটিতে বক্তব্য দিতে গিয়েছিলেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত নগর রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রনায়ক লি কুয়ান ইউ। তিনি মূলত কথা বলেছিলেন, তৎকালীন ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে। কিন্তু সেদিন তরুণ এ রাষ্ট্রনায়কের বক্তব্যে অনেকের কাছেই একটা স্পষ্ট মেসেজ গিয়েছিল যে, একদিন এই তরুণই পৃথিবীর জন্য যুগান্তকারী কিছু করবেন, এবং সর্বকালের সেরা গুটি কয়েক রাষ্ট্রনায়কদের সাথে তার নামও উচ্চারিত হবে।

সেই ভবিষ্যৎবাণী শুধু সত্যিই করেনি তিনি, নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে পৌঁছাতে পারেনি কেউই। কারণ তিনি তৃতীয় বিশ্বের একটি নগর রাষ্ট্রকে তুলে এনেছেন প্রথম বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের তালিকায়। তার জাদু স্পর্শেই সিঙ্গাপুর এখন বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরের জনগণের কাছে লি কুয়ান ইউ শুধুমাত্র প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন, একই সঙ্গে তাদের স্বপ্নকে সত্যি করার জাদুকরও বটে।

১৯৫০ এর দশক ছিল এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার সময়। সে সময় বিশ্বে জওহরলাল নেহরু বা গামাল আবদেল নাসেরেরা যেভাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন, ততটা পরিচিত ছিলেন না লি কুয়ান। ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মালয়েশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সিঙ্গাপুর। কিন্তু সেই জোট থেকে বের হয়ে ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সিঙ্গাপুর।

দীর্ঘ সময় বৃটিশ ঔপনিবেশে থাকার পর ফেডারেশন অব মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ৯ আগস্ট ১৯৬৫ দেশটি স্বাধীন হয়। এর পরের ইতিহাস বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস, একটি জাতি গঠনের ইতিহাস। গরিবানাকে হটিয়ে সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের ইতিহাস। যে সময় সিঙ্গাপুরকে স্বাধীন সত্তা নিয়ে একাকী পথ চলতে হয়েছিল, সে সময় ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়। বিশ্বের একদিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ, অন্যদিকে পুঁজিবাদী সমাজ।

সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এমন একটি অবস্থা থেকে সিঙ্গাপুরের আজকের এই অবস্থার মূল কারিগরের নাম সেই লি কুয়ান ইউ। দক্ষ ও সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বের দ্বারা সিঙ্গাপুরকে করেছেন স্বপ্নযাত্রার অংশ। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই দেশটির হাল ধরেছিলেন লি কুয়ান ইউ। সদ্য উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়া একটি দেশের যেসব সমস্যা থাকার কথা, তা থেকে ব্যতিক্রম ছিল না সিঙ্গাপুরও। দায়িত্ব নিয়েই লি কুয়ান বুঝেছিলেন দেশের উন্নয়ন করতে হলে রাজনৈতিক স্থিরতা থাকা প্রয়োজন। আর তাই আদর্শ ও উপলব্ধ বাস্তবতার মিশেল ঘটিয়েছিলেন তিনি। তার রূপায়ন তিনি করেছিলেন সরকারি নানা নীতিতে।

প্রথম থেকেই দেশটিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ছিলো। টাইম ম্যাগাজিনের সাবেক এশিয়া বিষয়ক সম্পাদক ডোনাল্ড মরিসন সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো যেখানে দুর্নীতিতে জর্জরিত, সেখানে আক্ষরিক অর্থেই সিঙ্গাপুরে কোনো দুর্নীতির লেশমাত্র ছিলো না। আইনের প্রশ্নে এখানে কারো জন্য কোনো ছাড় নেই। সবার জন্য আইন সমভাবে প্রযোজ্য। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে ১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এ দেশে মোট ৪০৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যা জনসংখ্যার অনুপাতে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে অ্যামনেস্টি কর্তৃক সমালোচিত। লি কুয়ান এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলন করেছেন যেখানে কোনো করপোরেট ক্রাইম নেই, কোনো গ্যাংস্টার নেই, চাঁদাবাজ নেই, মাফিয়া চক্র নেই, মাদক সম্রাট নেই। উপরন্ত মানুষ এবং সম্পদ রাষ্ট্র কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত। পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা শতভাগ নিষ্কলুষ এবং গণমুখী।

দায়িত্বগ্রহণের শুরুতেই তিনি সিঙ্গাপুরকে আরো পর্যটক আকর্ষক নগরীতে রুপায়ন করতে চেয়েছিলেন। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর স্থাপন করলেন।সত্তরের দশকে এশিয়া অঞ্চলের বিমানবন্দরগুলো অতটা নিরাপদ ছিল না। কিন্তু সরকার বুঝতে পেরেছিল বিদেশিদের কাছে প্রথম ইতিবাচক মনোভঙ্গি হচ্ছে বিমানবন্দর। সমুদ্র বন্দরগুলোর আরো আধুনিকায়ন করলেন। পরিসরও সম্প্রসারিত করা হলো। এখনো সিঙ্গাপুরের সমুদ্রবন্দর বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম।

পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলা হয়। এমনকি তাদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ছাড়ও দেয়া হয়। বিশালাকারের বেকার জনগোষ্ঠির জন্যও সরকারি অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করা হয়। দেশের আইনগুলোও ব্যবসাবান্ধব করে তৈরি করা হয়। তার উপর ভৌগলিকভাবেই সিঙ্গাপুর ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য উপযোগী একটি স্থান। সাগরপথে ইউরোপ আমেরিকার যত জাহাজ চলাচল করে তার অধিকাংশই সিঙ্গাপুর বন্দরে জ্বালানির জন্য থামতে হয়। এভাবে সমুদ্র বন্দরভিত্তিক বাণিজ্যও দিনদিন রমরমা হয়।

লি কুয়ান কিন্তু আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সব সময় সমঝোতা করে চলেননি। যখন প্রয়োজন মনে হয়েছে, তখন তিনি ইস্পাত কঠিন চরিত্রের এক রাষ্ট্রনায়ক। ১৯৭১ সালে সিঙ্গাপুর থেকে ব্রিটিশ বাহিনীর সামরিক ঘাঁটি প্রত্যাহারের ঘটনাতেই তা প্রমাণিত হয়। সেক্ষেত্রে নিজ দেশের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তাকেই তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

লি কুয়ান ইউ’র পররাষ্ট্রনীতি ছিল সিঙ্গাপুরের উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি। তিনি একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের বন্ধু বানিয়েছেন, অন্যদিকে অর্জন করেছিলেন এশিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্র চীনের বিশ্বাস। এ দুই বিপরীত মেরুর দেশের মধ্যে তিনি হয়েছিলেন সম্পর্কের সেতুবন্ধন। শুধু সামরিকভাবে নয়, এই দুই দেশ সিঙ্গাপুরকে সহযোগিতা করেছিল বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা রেখে। আর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু বানিয়ে তার ভিত্তি রচনা করেছিল লি কুয়ান ইউ’র সফল কূটনীতি।

তবে একগুঁয়েমির প্রমাণও আছে তার চরিত্রে। দেশ পরিচালনায় যাকে বাঁধা মনে করেছেন তাকেই সরিয়ে দিয়েছেন। তার সময়ে বিরোধী অনেক নেতার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছেন। ১৯৮৬ সালে বিরোধী দলকে হেনস্তা করার একটি খবর প্রকাশের জেরে প্রায় ৯ মাস ধরে টাইম ম্যাগাজিনের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ছিলো সিঙ্গাপুরে।

আরো পড়ুন :

জেলেদের গ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর রাষ্ট্র, কীভাবে? (পর্ব ১ম)



মন্তব্য চালু নেই