কলকাতায় যেভাবে শুরু হয় যৌনকর্মীদের আন্দোলন

ভারতের কলকাতা শহরে ২০০১ সালের ৩ মার্চ কয়েক হাজার যৌনকর্মী তাদের অধিকার আদায়ে এক বিরল সমাবেশের আয়োজন করেন। সেটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় যৌনকর্মীদের নিজ উদ্যোগে এ ধরনের প্রথম আন্দোলন এবং ওই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এর পর থেকে প্রতি বছর ৩ মার্চ পালন করা হয় যৌনকর্মীদের অধিকার দিবস হিসেবে।

যৌনকর্মীরা এ সমাবেশ আয়োজন করেছিলেন অধিকার এবং তাদের প্রতি বৈষম্যের বিষয়গুলো তুলে ধরতে। ভারতের একজন শীর্ষস্থানীয় এইচআইভি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক স্মরজিৎ জানা কলকাতার যৌনকর্মীদের সাহায্য করেছিলেন এ সমাবেশ আয়োজনে।

১৯৯০ থেকে জানা কলকাতার যৌনকর্মীদের সাহায্য করে আসছেন। ১৯৯৫ সালে তার সহায়তা নিয়ে যৌনকর্মীরা গড়ে তোলেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি নামে একটি সংস্থা, যাতে এর মাধ্যমে তারা তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে পারেন।

তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই এই পেশাকে সামাজিক এবং আইনগতভাবে মেনে নেয়া হয় না। তাই যৌনকর্মীরা এই মেলার মাধ্যমে চেয়েছিলেন তাদের পেশার কথা, তাদের জীবনের কথা এবং সমাজের অন্য পেশার মানুষদের মতো তাদেরও অধিকারকে যে মর্যাদা দেয়া উচিত তা তুলে ধরতে।

ওই সমাবেশের নাম দেয়া হয়েছিল ‘মিলনমেলা’। ২০০১ সালের ওই আয়োজনে হাজির ছিলেন ভারতী দে নামে একজন যৌনকর্মী, যিনি ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন।

তাদের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন তিন হাজারের ওপর যৌনকর্মী। সঙ্গে ছিল তাদের সন্তানরা। তারা এসেছিল প্ল্যাকার্ড হাতে। চিকিৎসক জানা বলেন, এটা ছিল তাদের জন্য এক ধরনের বিজয়। কারণ সেই প্রথমবার তারা নিজেরা তাদের ইস্যুগুলো তুলে ধরতে নিজেরাই একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন।

এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ একটি যৌনপল্লী- কলকাতার সোনাগাছিতে রয়েছে কয়েকশ পতিতালয়। ভারতে যৌনকর্মীদের পেশা আইনত বৈধ হলেও প্রকাশ্যে এ বিষয়ে প্রচার চালানো বা পতিতালয়ের মালিক হওয়া আইনসিদ্ধ নয়। যেটা যৌনকর্মীদের ব্যবসা চালানোর জন্য সমস্যা তৈরি করে।

ভারতী দে বলেন, তিনি ছিলেন গ্রামের মেয়ে। ছোটবেলা বাবা মারা যাওয়ার পর দাদারা চেয়েছিল বোনদের লেখাপড়া শেখাবে না- আমাদের বিয়ে দিয়ে দেবে। কিন্তু অনেক ফাইট করে আমি মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছিলাম। ক্লাস নাইন-টেনে বই কেনা দাদারা বন্ধ করে দেয়ায় আমি রেগুলারে পরীক্ষা দিতে পারিনি।

তিনি বলেন, পরীক্ষা দেয়ার পর কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে কসমেটিক সেলস গার্লের কাজ নেন। তার উদ্দেশ্য ছিল রেজাল্ট বেরোনোর পর তিনি আবার পড়াশোনা করবেন। এর মধ্যে হাত খরচের জন্য এবং পাছে বিয়ে দিয়ে দেয় এই ভয়ে কাজ নিয়েছিলেন।

কিন্তু সেটাতে যথেষ্ট পয়সা ছিল না। আমার যখন ২১ বছর বয়স, তখন একজন আমাকে বলল একটা কাজে আমি তোকে নিয়ে যাব। করবি? সে একজন রেড-লাইট এলাকার বাড়িওয়ালি ছিল। ওই বাড়িওয়ালি তাকে কাজ বোঝানোর পর জেনেশুনেই তিনি এই পেশায় আসেন, বলছিলেন ভারতী দে।

আর্থিক অসচ্ছলতা না থাকলেও ভারতী দে বলেছেন, অন্যান্য কারণে কর্মজীবনে তাকে নানা অসুবিধায় পড়তে হয়েছে।

মাস্তান, পুলিশ, পাড়ার ছেলে, পলিটিকাল লিডার বিনা পয়সায় মেয়েদের কাছে যাওয়া, মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া, এরকম প্রচুর জুলুম ছিল। যখন তখন মারধর, অত্যাচার দেখার পর আমি মেয়েদের সংগঠিত করে বলতাম চল একসঙ্গে ফাইট করি। কেন এই অত্যাচার হবে?

ডা. জানা বলছিলেন, এছাড়া সামাজিক জীবনে যৌনকর্মীদের বড় একটা সমস্যা ছিল তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করা। ছেলে-মেয়েদের পড়ানো ছিল প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। এর কারণ সমাজ তাদের ভালো চোখে দেখত না এবং তারা ছিল বৈষম্যের শিকার।

সমাজে তাদের এই কলঙ্কিত ভাবমূর্তি মুছতে যৌনকর্মীরা চেয়েছিলেন স্থানীয় লোকেরা এ মেলায় আসুক। তাদের আশা ছিল পাড়ার লোকজন যদি যৌনকর্মীদের সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ পায়, তাহলে হয়তো তাদের মন থেকে ভয় বা আশঙ্কা দূর হবে। জানা বলেন, এই মিলনমেলার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের সব স্তরের মানুষদের সঙ্গে যৌনকর্মীদের মেলামেশার সুযোগ করে দিলে যৌনকর্মীদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ হয়তো বদলাতে পারে।

যৌনকর্মীদের যুক্তি ছিল তাদের কাজটাও একটা পেশা। তারাও কাজ করে খাচ্ছে। কিন্তু সমাজ তাদের মনে করে খারাপ- তারা পতিতা। সেই দৃষ্টিভঙ্গিটাই তারা চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছে। তারা সমাজকে তাদের অবস্থান বোঝাতে চেয়েছে। কেন তারা এই কাজ করছে- তাদের ইস্যু আর চ্যালেঞ্জগুলো কী?

সম্মেলনের আয়োজন হয়েছিল বিশাল এক স্টেডিয়ামে। কারণ ওই সময়কার ক্রীড়ামন্ত্রী তাদের উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন। ভারতী দে বলছিলেন, সম্মেলনে অনেকের প্রশ্ন ছিল কেন তারা এই পেশায় এসেছেন। তারা জানতে চেয়েছিলেন কেন আমরা এ পেশায় থেকে শ্রমিকের স্বীকৃতি চাইছি। আমার বুঝিয়েছিলাম কেন আমরা এই পেশায় এসেছি।

সম্মেলন চলেছিল চারদিন। প্রতিদিন ছিল আলাদা আলাদা ইভেন্ট। ছিল আলোচনা-প্রদর্শনী। অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই এসেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে। তবে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকেও যৌনকর্মীরা এসেছিলেন।

তাদের ইস্যু এবং চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েই তারা কথা বলেন চারদিনের ওই সম্মেলনে। ফুটবল স্টেডিয়ামে সামিয়ানা টাঙিয়ে নানাধরনের স্টল তৈরি করা হয়েছিল। সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ২৫ হাজার মানুষ। ভারতী দে বলছিলেন, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক অনেকেই তাদের কথা শুনে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন।

শহরের অনেক নামকরা সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক সম্মেলন শেষে বলেছিলেন সেই প্রথম তারা যৌনকর্মীদের কাজ এবং জীবন সম্পর্কে জেনেছেন, বলছিলেন ডা. জানা।

এমনকি সম্মেলনের শেষ দিনে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি থেকে কলকাতায় এসেছিলেন শুধু এই সম্মেলনে ভাষণ দিতে। তিনি পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে যৌনকর্মীদের হয়রানির সমালোচনা করেন। তার এ বক্তব্য যৌনকর্মীদের সাহস জুগিয়েছিল- বলেন ডা. জানা।

ভারতী দে ২০১৩ সালে যৌনকর্মীর কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। এখন তিনি দুর্বার মাহিলা সমন্বয়ক কমিটির প্রধান, যে কমিটি পশ্চিমবঙ্গের ৭৫ হাজারের ওপর যৌনকর্মীর অধিকার আদায়ে কাজ করছেন। বিবিসি বাংলা।



মন্তব্য চালু নেই