উত্তর কোরিয়ায় হস্তক্ষেপ করবে চীন?
উত্তর কোরিয়ার হুমকি মোকাবেলায় ‘সব ধরনের ব্যবস্থা এখন টেবিলে’ রয়েছে বলে দাবি করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচআর ম্যাক মাস্টার।
রোববার সকালের দিকে এশিয়ার এই দেশের ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যর্থ পরীক্ষার পর মার্কিন এই শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ক্ষেপণাস্ত্রের সর্বশেষ এ পরীক্ষা প্ররোচনামূলক ও অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা। উত্তর কোরিয়ার হুমকি মূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষায়।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সফরের কয়েক ঘণ্টা আগে ওই পরীক্ষা চালায় পিয়ং ইয়ং। তবে এটা পরিষ্কার যে, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চলমান উত্তজনা নিয়ন্ত্রণে আনতে মার্কিন কর্মকর্তারা পিয়ং ইয়ংকে কূটনৈতিক ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে এই অঞ্চলে মার্কিন মিত্রদের আশ্বস্ত করতে চাইছেন তারা।
নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচআর ম্যাক মাস্টার আফগানিস্তানে রয়েছেন; সেখানে তিনি কাবুলে আফগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। আফগানিস্তানে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ঘাঁটিতে সব বোমার মা বোমা (মাদার অব অল বোম্বস) হামলায় ব্যাপক হতাহতের পর তিনি আফগান সফরে রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের মাদার অব অল বোম্বস হামলায় কমপক্ষে ৯০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়া আইএসের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে। চলতি বছরের শুরু দিকে ক্ষমতায় আসার পর আইএসকে ধ্বংস করাই যুক্তরাষ্ট্রের মূল পররাষ্ট্র নীতি হবে বলে জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
কিন্তু মার্কিন প্রশাসন এরই মধ্যে সিরিয়া সংঘাত ও উত্তর কোরিয়ার নতুন আগ্রাসনসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে পড়েছে। এর ফলে কার্যত ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট নীতির সঙ্গেও আপাত দৃষ্টিতে মতভেদ স্পষ্ট হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চরম উত্তেজনাকর এসব কূটনৈতিক ঝামেলার সূত্রপাত হয় দুই সপ্তাহ আগে সিরিয়ার আল-শেখুইনে রাসায়নিক গ্যাস হামলার পর। এতে কয়েক ডজন মানুষের প্রাণহানির পর সিরীয় বিমান ঘাঁটিতে অন্তত ৫৯টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন সত্ত্বেও ওই রাসায়নিক হামলার জন্য সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে দায়ী করলেও দামেস্ক’র অন্যতম মিত্র রাশিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
ওই হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, অনেক সীমা অতিক্রম করেছে এই হামলা। এর পরপরই ট্রাম্পের নীতির ইউ টার্ন দেখা যায় দেশটিতে। কেননা এর আগে মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, সিরিয়ায় আইএস’ই তার মাথা ব্যথার কারণ নয়; আসাদ সরকার নয়।
আড়াই কোটি মানুষের দেশ উত্তর কোরিয়া আবারও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে। ছোট্ট এবং দরিদ্র এই দেশ প্রতিনিয়তই খবরে উঠে আসছে। তবে এবার যেভাবে গণমাধ্যমে জায়গা পেয়েছে তা অতীতের চেয়ে একটু ভিন্ন। পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জেরে চিরশত্রু ও অন্যতম প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়েছে পিয়ং ইয়ং।
২০০৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচবার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া। কিন্তু ষষ্ঠবার পরীক্ষা চালানোর ঘোষণা দেয়ায় বেঁধেছে বড় বিপত্তি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়াকে এই ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে দেয়ার মতো মুডে নেই। এরপরও রোববার ব্যর্থ হয়েছে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা।
কোরিয়ার উপসাগরে জঙ্গিবিমানবাহী জাহাজ মোতায়েন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যেকোনো সময় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে চীন। এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘদিনের মিত্র চীনকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন। ওয়াশিংটন চাইছে চীনের সহায়তায় পিয়ং ইয়ং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে।
কয়েক দিন আগেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ট্রাম্প- শি সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, উত্তর কোরিয়া সমস্যা সমাধানে যদি চীন এগিয়ে না আসে; তাহলে আমরা এর সমাধান টানবো। এর কয়েক ঘণ্টা পরই কোরীয় উপদ্বীপে জঙ্গিবিমানবাহী ওই জাহাজ মোতায়েন করে ট্রাম্প প্রশাসন।
উত্তর কোরিয়াকে সমস্যা হিসেবে মনে করেন অনেক মানুষ। পারমাণবিক পরীক্ষা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৈদেশিক জালমুদ্রা তৈরি, অবৈধ মাদক উৎপাদন ও বিক্রি এবং নিজ দেশের নাগরিকদের অন্য দেশে গুপ্ত হত্যার অভিযোগও রয়েছে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে চীনের সমস্যা কেন? উত্তর কোরিয়ার প্রধান কূটনৈতিক মিত্র চীন হলেও দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিলতায় পরিপূর্ণ। চীন কীভাবে গোলযোগপূর্ণ একটি সঙ্গী রাষ্ট্র পেল? দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়ে মানুষ যতটুকু জানে তার চেয়েও গভীর এ বিষয়টি।
১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধে লড়াই করেছিল চীন। ১৯৫০ সালে নতুন কমিউনিস্ট শাসিত চীনের অন্তত ৩০ লাখ সেনাবাহিনী কোরিয়া যুদ্ধে অংশ নেয়। এই যুদ্ধে ১ লাখ ৮০ হাজার সৈন্যের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধ শেষের এক বছরের মাথায় এ ঘটনা ঘটে। দক্ষিণ কোরিয়ায় উত্তরের হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে হামলা চালায়নি চীন। ডগলাস ম্যাক আর্থার নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘের সৈন্যরা উত্তর কোরিয়াকে পরাজিত করার পর পাল্টা হামলা চালায়। চীন অপ্রত্যাশিতভাবেই ওউ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দুই কোরিয়ার মাঝে বিভাজন রেখা টেনে দেয়; যা আজও বলবৎ আছে।
১৯৫০-৫৩ সালের কোরিয়ান যুদ্ধে চীনের হস্তক্ষেপ প্রথম ছিল না। ১৫৯০ সালেও একই ধরনের ঘটনা দেখা যায়। ১৫৯২ সালে কোরিয়ায় হামলা চালায় জাপান। পরে চীন এই লড়াইয়েও হস্তক্ষেপ করে।
এছাড়া চীনের আরেকটি চাওয়া আছে। সেটি হচ্ছে নতুন একটি কোরীয় যুদ্ধ। তবে চীনের এই চাওয়ার ভিত্তি হলো দক্ষিণ কোরিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চলমান তুমুল মার্কিন উত্তেজনায় চীন যদি মধ্যস্থতা করেও তাহলে পিয়ং ইয়ংয়ে কিম জং উনের শাসনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। এমনকি দুই কোরিয়ার শান্তিপূর্ণ একত্রীতকরণও সম্ভব হবে না। কিম ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও তার শাসন ও রাজত্ব বলবৎ রাখবে চীন। এমন হস্তক্ষেপের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি সম্পর্কে যে কেউই অনুমান করতে পারেন।
সূত্র : দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, রয়টার্স, বিবিসি।
মন্তব্য চালু নেই