ইসলামিক স্টেটে সাদ্দাম হুসেইনের ভূত

বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী বেসামরিক শক্তিশালী সংগঠন হলো ‘ইসলামিক স্টেট’ বা দায়েশ। এই সংগঠনটির মূল অংশের অন্যতম সদস্য হওয়ার সাধ নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন সিরিয়ার সাবেক বিদ্রোহী সদস্য আবু হামযা। ইসলামিক যে ইউটোপিয়ার কথা বিশ্বাস করে বিভিন্ন দেশ থেকে জিহাদিরা ইসলামিক স্টেটে নাম লেখাচ্ছে, ঠিক একই স্বপ্ন দেখে আবু হামযাও যোগ দিয়েছিলেন দায়েশে।

যোগদানের পর আবু হামযা যতই মূল অংশের কাছে যেতে চান ততই তার সামনে ইরাকিরা চলে আসে। এমন কিছু ইরাকি ব্যাক্তির নিয়ন্ত্রনে তাকে চলতে হয় যাদের নির্দেশ দাতারা হয় যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করছেন অথবা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের পরিচয় হামযার কাছে স্পষ্ট ছিল না। ২০১২ সালের শেষের দিকে ইসলামিক স্টেটের এক আলোচনা সভায় কিছু বিষয় নিয়ে বিরোধীতা জানায় হামযা। এই বিরোধীতার জের ধরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং একজন মুখোশধারী ইরাকি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। হামযার কাছ থেকে যাবতীয় তথ্যাদি সে লিপিবদ্ধ করে নেয়।

সিরিয়ায় একটি ছোটো দলের নেতা আবু হামযা। অনেক চেষ্টা করেও হামযা ওই ইরাকিদের সত্যিকারের পরিচয় উদ্ধার করতে পারেননি। এমনকি তাদের কোনো নামও নেই, শুধু আছে কোডনাম। যদিও হামযা নিশ্চিত যে তারা সেই মানুষ যারা সাদ্দাম হুসেইনের আমলে সরকারি বাহিনীতে ছিলেন। তার বিশ্বাস মতে, মুখোশ পরিহিত ব্যাক্তিও ছিলেন ইরাকি গোয়েন্দা বিভাগের সদস্য এবং বর্তমানে তিনি ইসলামিক স্টেটের প্রচ্ছন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর হয়ে কাজ করছেন।

ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যারা বছরব্যাপী যুদ্ধ চালাচ্ছেন তারা যতটা বাগদাদী সম্পর্কে সচেতন ঠিক ততটাই অসচেতন ছদ্মবেশে থাকা ইরাকি অফিসারদের ব্যাপারে। সাদ্দাম হুসেইনের আমলে যারা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদে ছিলেন তাদের অনেকেই এখন ইসলামিক স্টেটের হয়ে কাজ করছেন। শুধু তাই নয় ইরাকের স্থানীয় আমির এবং যুবরাজরাও গোপনে ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যুক্ত। তবে ইসলামিক স্টেটের অভ্যন্তরে ইরাকি বাথ পার্টির সদস্যরা বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করছেন। বর্হিদেশ থেকে জিহাদিদের ইরাক-সিরিয়ায় আনা এবং মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা জারি রাখার কাজগুলো সব ওই ইরাকি অফিসাররাই করেন বলে হামযার বিশ্বাস।

তবে ইসলামিক স্টেটের প্রাথমিক নেতারা তাদের কার্যসিদ্ধি করার জন্য ওই ইরাকি অফিসারদেরই সাহায্য নিয়েছিলেন। সাবেক বাথ পার্টির সদস্যরাই চোরচালানি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল ছিলেন ১৯৯০ সালের অবরোধের পর থেকে। যে কারণে সিরিয়া এবং ইরাকে আইএস কর্তৃক দখল করে নেয়া তেলকূপগুলো থেকে উত্তোলিত তেল বিক্রি করতে বেগ পেতে হচ্ছে না আইএসকে।

সিরিয়ার স্থানীয় আমিররা মূলত একজন ডেপুটি ইরাকির ছত্রছায়ায় সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু ওই ইরাকির চেহারা কখনোই দেখতে পায়নি ওই স্থানীয় আমিরেরা। তারা শুধু দূরবর্তী কোনো এক স্থান থেকে নির্দেশ পেয়েছে। গত গ্রীস্মেই ইসলামিক স্টেটের মূল অংশের সদস্য হতে না পেরে পালিয়ে তুরস্কে চলে আসে আবু হামযা। জীবনের ঝুঁকি জেনেও তিনি শেষমেষ বাথ পার্টির হাতে ব্যবহৃত হবেন না বলে চলে আসেন। ‘সব সিদ্ধান্তই মূলত ইরাকিরা নেয়। আর তাদের বেশিরভাগই সাবেক ইরাকী অফিসার। ইরাকি অফিসাররাই নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশলগত দিক তারাই পরিচালনা করে। কিন্তু ইরাকিরা নিজেরা যুদ্ধ করে না। তারা বিদেশি যোদ্ধাদের যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়।’
HUSSAIN
২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনীর হাতে সাদ্দাম হুসেইনের বাথ পার্টি মার খাবার পর স্থানীয় সুন্নী মুসলিমরাই সাদ্দাম হুসেইন অনুগতদের আশ্রয় দেয়। কারণ শিয়া নিয়ন্ত্রিত সরকারের হাতে ইরাকের সুন্নীরা ২০০৩ সাল পরবর্তী থেকেই অত্যাচারের শিকার হয়। নুরী আল মালিকির হাতে সুন্নীরা অত্যাচারিত হওয়ার পর বাথ পার্টির সদস্যরাই সুন্নীদের পরমবন্ধু হিসেবে দেখা দেয়। এবং এই পরমবন্ধু অংশটিই পরবর্তী সময়ে ইসলামিক স্টেটের মূল অংশে পরিণত হয়।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক লেখক হাসান হাসান বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন যে ইসলামিক স্টেট একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং এর কোনো কার্যকারিতা নেই। এটা একটা সন্ত্রাসী গোষ্ঠি কিন্তু এটা তার চেয়েও বেশি। এটা ইরাকে জন্মগ্রহন করা একটি প্রতিরোধ যা ইরাকের মাটিতে প্রোথিত।’ ২০০৩ সালে ইরাকের শাসন ছিল এল. পল ব্রেমার নামক এক মার্কিনীর হাতে। ধারনা করা হয় তার হাত ধরেই এই অস্থিরতা শুরু। রাতারাতি ইরাকের সেনাবাহিনী থেকে চার লাখ সদস্যকে স্রেফ নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয় বিতারিত সেনাসদস্যদের বিভিন্ন ভাতাদিও বন্ধ করে বন্দুক রাখার অনুমতি দেয়া হয় তাদের। সেসময় কর্ণেল জোয়েল রেবার্ণ এক লেখায় সংশয় প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, বাথ পার্টির বিতারিত সদস্যরা চরমপন্থী দল হিসেবে ইরাকের বুকে মাথাচাড়া দিতে পারে। মার্কিন সেনাবাহিনী আগাগোড়াই জানতো যে সাবেক বাথ পার্টির সদস্যরা সুযোগ পেলেই ইরাকের আল কায়েদার সঙ্গে যোগ দেবে। কিন্তু এটা জানা স্বত্ত্বেও মার্কিন প্রশাসন এব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করেনি।

আবু বকর আল বাগদাদির নেতৃত্বে সাবেক ওই বাথ পার্টির সদস্যরা একত্রিত হতে শুরু করে কিংবা ওই সদস্যদের গোপন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মঞ্চে বাগদাদির আর্বিভাব ঘটে। বাথ পার্টিকে নতুনভাবে জন্ম দেয়ার পরিকল্পনাও হতে পারে ইসলামিক স্টেট। ভুলে গেলে চলবে না, আজকের ইসলামিক স্টেট কিন্তু বাথ পার্টির কায়দাতেই নিজেদের আন্দোলনকে অর্ন্তবর্তীকালীন আন্দোলন হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। বাথ পার্টি যেভাবে ইরাক থেকে শুরু হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি ইসলামিক স্টেটও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে ১৯৯৪ সালে সাদ্দাম হুসেইন যেভাবে সেক্যুলার শব্দটিকে পাশ কাটিয়ে ‘আল্লাহই মহান’ শব্দটিকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন এবং শিয়াদের উপর অত্যাচার শুরু করেন, একই রাস্তা দায়েশরাও অনুসরণ করছে। সেসময় ইরাকে যে সমস্ত কর্মকর্তারা(সামরিক-বেসামরিক) মদ খেতেন তারাও মদ বাদ দিয়ে সালাফিস্ট আন্দোলনে সামিল হয়।



মন্তব্য চালু নেই