“ইচ্ছা ছিল খাদিজাকে ওখানেই শেষ করে দেয়ার”

লজিং শিক্ষক হিসেবে বাসায় আশ্রয় নিয়েই স্কুলপড়ুয়া খাদিজা আক্তার নার্গিসকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে বদরুল আলম। পড়ানোর নামে প্রেমে বাধ্য করার বহু চেষ্টা চালায়। নানা হুমকিও দেয়। এসব জানাজানি হলে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয় বাসা থেকে। তারপরও পিছু ছাড়েনি বদরুল। অন্যদিকে প্ররোচনা ও হুমকিতে হার মানেনি নার্গিস। এ কারণে বদরুল সিদ্ধান্ত নেয় খাদিজাকে হত্যার।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমের কথায় উঠে আসে এসব তথ্য। মঙ্গলবার সে বলে, খাদিজা দীর্ঘদিন থেকে আমাকে পাত্তা না দেয়ার কারণেই তার ওপর আমি চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি। নগরীর আম্বরখানার এক দোকান থেকে ২৫০ টাকা দিয়ে চাপাতি কিনি এবং হত্যার উদ্দেশ্যেই তাকে কোপাই। ইচ্ছা ছিল ওখানেই তাকে শেষ করে দেয়ার।

দু’দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে নার্গিস। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় ছিল ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে। আর মেয়ের এ সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা মনোয়ারা বেগম। তার আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে বাড়ি। গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ সান্ত্বনা দিতে ছুটে আসছেন সেখানে।

মঙ্গলবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, পুলিশ ছাড়া পরিবার, স্বজন বা সংগঠনের কেউ নেই বদরুলের পাশে। অন্য রোগীদের দেখতে যারা ওই ওয়ার্ডে যান তারাও তাকান তির্যক দৃষ্টিতে। রূঢ় মন্তব্য করেন। এরই ফাঁকে কথা হয় বদরুলের সঙ্গে। সে বলে, আমি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হলে সিট পাইনি। এ সময় লজিং ছিলাম নার্গিসদের বাড়িতে। এ সুবাদে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু পরে কথা রাখেনি নার্গিস। আমি তাকে নিয়ে সব সময়ই সিরিয়াস। কিন্তু আমার বেলায় সে ছিল একবারে উদাসীন। তাই তাকে শেষ করে দিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার প্রস্তুতি নেই।

বদরুল আরও বলে, সোমবার এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় চাপাতিটি লুকিয়ে রাখি সঙ্গে থাকা ব্যাগে। পরীক্ষার আগেই এমসি ক্যাম্পাসে পৌঁছাই। ওর কাছে গিয়ে কথা বলি। কিন্তু সে সন্তোষজনকভাবে কোনো কথার উত্তর দেয়নি। এতে আমি আরও প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে উঠি। পরীক্ষা শেষে নার্গিসকে হল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখি। তাকে মসজিদের পাশে দেখে কাছে ভিড়তে থাকি। কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু সে আবারও পাত্তা দিতে চায় না। উল্টো রূঢ় আচরণ করে। আমি ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে কোপাতে থাকি। ইচ্ছা ছিল ওখানেই তাকে শেষ করে দেয়ার। এরপর লোকজন নার্গিসকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় ও আমাকে গণপিটুনি দিতে শুরু করে।

বদরুল আরও জানায়, আগেই আমি তাকে বলেছিলাম, আমার মায়ের বুক খালি হলে তোর মায়ের বুকও খালি করে যাব। তারপরও সে আমাকে অবজ্ঞা করেই চলতে থাকে। বদরুলের দাবি, নার্গিস যে মোবাইল সিম ব্যবহার করত সেটা আমার নামে কেনা। ওই সিমের কললিস্ট সংগ্রহ করে দেখেছি, আমি ছাড়া অন্য সবার সঙ্গেই সে যোগাযোগ রাখছে। একমাত্র আমাকে, আমার ফোনের পাত্তা দেয় না সে। এসব কারণেই তার ওপর আমি চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি।

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার সুনাইঘাতি কুম্ভবয়ন গ্রামের সাইদুর রহমানের ছেলে বদরুল আলম। সে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় ২০০৮-০৯ সেশনে। ভর্তির পর সিট পায়নি হলে। তাই লজিং থাকে সদর উপজেলার আউশা এলাকার সৌদী আরব প্রবাসী মাসুক মিয়ার নগরীর জালালাবাদ এলাকার বাসায়। এ সময় খাদিজা টুকের বাজার সফির উদ্দিন হাইস্কুলে শিক্ষার্থী ছিল। একপর্যায়ে ২০১০ সালে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন বদরুলের সঙ্গে খাদিজার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। খাদিজা তখন অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তবে এরপরও খাদিজাকে মানসিকভাবে প্রায়ই অত্যাচার করত বদরুল। তখনি লজিং থেকে বদরুলকে বের করে দেয়া হয়। উঠে শাহপরান হলে। এ সময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করত।

২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি টুকের বাজারে দা নিয়ে খাদিজাকে মারতে গেলে এলাকাবাসী ধরে পিটুনি দেয়। মান বাঁচাতে শিবির মেরেছে বলে ক্যাম্পাসে প্রচার করে বদরুল। তারপর থেকে ক্যাম্পাসে খুব একটা দেখা যায়নি তাকে। এমনকি বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়রদের সঙ্গেও খুব বেশি মিশত না সে। শিক্ষাজীবন সম্পন্ন না করেই সে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়।

বেশ কিছুদিন পর সে ছাতকের আয়াজুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করে। এ সময় বদরুল আবার সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় নার্গিসের সঙ্গে। বদরুলের ফেসবুক প্রোফাইলে দেখা যায় ঘটনা ঘটানোর কিছু আগে সর্বশেষ পোস্ট করেছে সে। সেখানে লিখেছে, ‘নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষগুলোর কাছে আমি সবিনয়ে ক্ষমাপ্রার্থী। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া কেউ আপন নয়।’



মন্তব্য চালু নেই