ইউপি নির্বাচনে চাঙা অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা
সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে ঘিরে অবৈধ অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়েছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকায় অস্ত্র কিনছে ইউনিয়ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা। আবার প্রার্থীদের কাছে নিজেদের কদর বাড়াতে অবৈধ অস্ত্র জোগাড় করছে স্থানীয় সন্ত্রাসীরাও।
এদিকে, এর সুযোগ নিয়ে অস্ত্রের মজুদ বাড়াচ্ছে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার ও জঙ্গিরাও। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠ পর্যায়ের এমন চিত্র নিয়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধান চলছে বলে জানা গেছে।
মাঠ পর্যায়ের এসব তথ্য সংগ্রহ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, একটি গোয়েন্দা সংস্থা। অস্ত্রবাজ চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রটির পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীচক্র ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে আসা বিদেশি ক্ষুদ্র অস্ত্র এখন নির্বাচনের মাঠে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীদের পেশিশক্তির মূল উৎস এসব অবৈধ অস্ত্র। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশে ঢোকা এসব অস্ত্রের বেশিরভাগ ক্রেতাই ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বলে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা গেছে।
অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিদের যোগাযোগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অপরাধী চক্র যতই অবৈধ অস্ত্রের শক্তি দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে কাবু করার চেষ্টা করুক না কেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একসময় না এক সময় তাদের গ্রেপ্তার করবেই। ইতোমধ্যে, অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকার করেছেন যে, ইউপি নির্বাচন কেন্দ্র করে তাদের অস্ত্র ব্যবসা বেড়েছে। সন্ত্রাসীদের পাশপাশি ইউপি নির্বাচন প্রার্থীরাও তাদের ক্রেতা। তবে এসব অস্ত্র উদ্ধারে ঢাকাসহ সারাদেশে কাজ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।’
সম্প্রতি গ্রেপ্তারদের তথ্য অনুযায়ী, মাঠ পর্যায়ের সন্ত্রাসীদের হাতে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র রয়েছে।
ডিবি সূত্র জানায়, গত বুধবার রাজধানীর বংশাল থানা এলাকার ইউসুফ মার্কেট থেকে ছয়টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ ১০টি ম্যাগজিন এবং ৩০ রাউন্ড গুলিসহ দবির উদ্দিন ওরফে তুহিন, আব্দুল হামিদ ও ইরফানুল হাসান পিয়াস নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
ইতোমধ্যে, জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন, ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রভাব খাটানোর জন্য কুমিল্লার ইউপি সদস্যরা তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু অস্ত্র কিনেছেন। তারা আরো অস্ত্রের চাহিদার কথা জানিয়েছেন।
ওই তিনজনের তথ্যের ভিত্তিতে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ অস্ত্রের প্রভাবে অনেকের পেশিশক্তি বেড়েছে। এ কারণে প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। আর অস্ত্রধারীদের প্রভাব এতই বেড়েছে যে, গা বাঁচাতে ভোটের আগেই অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি জানান, নির্বাচনের মাঠে এখন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের দাপট চলছে। তাদের পেশিশক্তির ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রতিপক্ষরা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বেল্টের কুমিল্লা শহর কেন্দ্রিক সাতজন অবৈধ বড় মাপের অস্ত্র ব্যবসায়ীর নাম পাওয়া গেছে। এদের কাছ থেকে ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীদের পাশাপাশি তাদের ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা ২৩টি ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র (পিস্তল ও রিভলবার) কেনার অগ্রিম টাকা দিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিটি অস্ত্রের জন্য তাদের কাছ থেকে এক থেকে দুই লাখ টাকা নেয়া হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা এসব তথ্যের পাশপাশি আরো জানান, সম্প্রতি, ইউপি নির্বাচনের চাহিদা অনুযায়ী অবৈধ অস্ত্র কেনার জন্য তাদের সদস্য পিয়াস কুমিল্লা থেকে অস্ত্র কিনতে ঢাকায় আসেন। ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা চুক্তিতে একেকটি অস্ত্র কেনার পরিকল্পনা ছিল তার। ধরা না পড়লে এসব অস্ত্র নিয়ে গিয়ে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করতেন। তিনি একেকটি অস্ত্র এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করতেন। মূলত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চাহিদা থাকায় অস্ত্র কিনতে ঢাকায় এসেছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ছাড়াও চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী ও অপরাধী চক্রের সদস্য এবং জামায়াত-শিবির জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরাও তাদের অস্ত্রের ক্রেতা।
পুলিশ সদর দপ্তর তথ্যমতে, গত ছয়মাসে সারাদেশে কয়েকশ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সদস্যরা। ওই সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন অবৈধ অস্ত্রসহ অপরাধী চক্রের অন্তত দুই শতাধিক সদস্য। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে ২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল সংখ্যক গুলি ও ম্যাগজিন জব্দ করা হয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এসব অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঢাকার অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সারাদেশের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ রয়েছে। ঢাকার ব্যবসায়ীরা আবার চাপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। সেখান থেকে একটি গ্রুপ সীমান্তের ওপারে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এভাবে একাধিক চক্রের মাধ্যমে অস্ত্র কেনাবেচা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অস্ত্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য তাদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অস্ত্র ব্যবসায় সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্সরাও তাদের খুবই ঘনিষ্ঠ। অস্ত্রের ক্রেতা হিসেবে জামায়াত-শিবির, নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী, এমনকি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে এ ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ নেই। নিজেদের প্রয়োজনে তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অস্ত্র কিনে থাকেন। এসব অবৈধ অস্ত্রের মাধ্যমে হত্যা, প্রভাব বিস্তার অর্থাৎ পেশিশক্তি দেখানো হয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার পাশাপাশি শক্তি প্রদর্শনের জন্য সম্প্রতি তাদের কাছ থেকে গ্রামের ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী, রাজনৈতিক নেতাসহ ইউপি সদস্যরা তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনেছেন বলে তিনি দাবি করেছেন।
গত ছয়মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৫টি অস্ত্র জব্দ করেছে ডিবি। এ ছাড়া র্যাবের অভিযানে আরো ৩০টি অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি এলাকা থেকে দুটি অবৈধ ক্ষুদ্রাস্ত্রসহ চারজনকে আটক করেছে। এ সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪৪ জন অস্ত্র ব্যবসায়ী। তবে যত অবৈধ অস্ত্র সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকছে, তার খুব কম সংখ্যক অস্ত্রই জব্দ হয়েছে বলে ডিবি ও র্যাব সূত্র জানিয়েছে।
ডিবির একটি সূত্র জানায়, দেশের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর দক্ষিণ অর্থাৎ সব সীমান্ত দিয়েই দেশে অবৈধ অস্ত্র আসছে। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সীমান্তের দু’পাড়েই সক্রিয়।
চাপাইনবাবগঞ্জের পাশাপাশি রাজশাহী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লার সীমান্ত দিয়ে বেশি অস্ত্র আসছে। ঢাকায় বেশিরভাগ অস্ত্র আসে ট্রেনে করে। এ ছাড়া মালবাহী ট্রাকসহ অন্য পরিবহনের মাধ্যমেও সারাদেশে অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে।
মন্তব্য চালু নেই