অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছে নেপালের মুসলিমরা

নেপালের রাজধানী কাঠমুণ্ডুতে অবস্থিত জাদুঘরটির পাশেই কাঠমুণ্ডু জামে মসজিদ। এক সময়ের রাজপ্রাসাদটিই পরে জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে। মসজিদে ঢুকতেই এক কোনে চোখে পড়ে বেগম হজরত মহলের সমাধি। অতীতের জাঁকজমক হারিয়ে সমাধিটি এখন অবহেলিত। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে অযোধ্যার রানী ছিলেন হজরত মহল। নেপালীরা অযোদ্ধাকে বলে আওয়াধ। ব্রিটিশদের সময়ে মূলত নেপাল এবং ভারতের উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশ মিলে ছিল অযোদ্ধা বা আওয়াধ।

১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর উত্তরপ্রদেশের আরেক শহর লখনৌ থেকে পালিয়ে নেপালে চলে যান হজরত মহল। সেখাতে তাকে আশ্রয় দেন নেপালের শাসক জং বাহাদুর রানা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীদের দমনে শাসকদের সৈন্য দিয়ে সহায়তা করেছিলেন জং বাহাদুর রানা। তবু হজরত মহলকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেন তিনি।

কাঠমুণ্ডু জামে মসজিদের সেক্রেটারি মোহাম্মদ হোসেন জানান, হজরত মহল যখন নেপালে পালিয়ে আসেন তখন তার সঙ্গে অনেক মুসলিম ভারত থেকে চলে আসেন।

তবে এরও অনেক আগে মুসলিমরা নেপালে প্রবেশ করেছিল। পনের শতকে কাশ্মীরের ব্যবসায়ীরা এক বাণিজ্যিক সফরকালে প্রথম কাঠমুণ্ডু ভ্রমণ করেন। তখন কাঠমুণ্ডুর নাম ছিল কান্তিপুর। তখন সেখানকার রাজা ছিলেন ভক্ত মাল্য। পনের শতকেই কাঠমুণ্ডুতে বসতি স্থাপন করে মুসলিমরা। কাঠমুণ্ডুর রাজপ্রাসাদ থেকে কয়েকশ গজ দূরে ৫০০ বছরের পুরনো কাশ্মীরী টাকিয়া মসজিদ সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে।

মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে নেপালী রাজ্যে শত শত বছর ধরে সুনামের সঙ্গে বসবাস করে এসেছে মুসলিমরা। দীর্ঘদিন পর্যন্ত নীরবেই বাস করে এসেছে মুসলিমরা। তবে ১৯৯৬ সালে মাওবাদী বিদ্রোহীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নীরবতা ভাঙতে শুরু করে তারা।’

নেপালের তিন কোটি জনগণের মাত্র পাঁচ ভাগ মুসলিম। ২০০৬ সালে মাওবাদী বিদ্রোহ দমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে বেশ সোচ্চার ছিল মুসলিমরা। কাঠমুণ্ডু মসজিদের ছোট্ট বারান্দায় বসে হোসেন বলেন, ‘মাওবাদী বিদ্রোহীরা মুসলিমদের তাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করে তোলে।’

২০০৮ সালে নেপালের রাজতন্ত্র ভেঙে পড়ে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে মাওবাদীদের নেতৃত্বাধীন সরকার। ওই বছরই মুসলিমদের উৎসবের দিনগুলোতে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করে সরকার।

সেবারই প্রথম কাঠমুণ্ডু থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে ভারত-নেপাল সীমান্তের কাছাকাছি নেপালী জেলা বাঙ্কেতে দেখা যায়, সবুজ পতাকায় কোরানের বিভিন্ন বানী লিখে মোহাম্মদ (স.) এর জন্মদিন পালন করছে সেখনাকার লোকজন। এ ধরনের উৎসব থেকেই বোঝা যায়, নেপালের আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে।

নেপলের দক্ষিণাঞ্চলীয় বাঙ্কে জেলাটি তারাই এবং মাধেস জেলা হিসেবেও পরিচিত। দেশটির মোট মুসলিমদের ৯৫ ভাগই বাস করে এখানে। তবে এখানকার বেশিরভাগ মুসলিমই অতি-দরিদ্র এবং ভূমিহীন। সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা হওয়া এবং রাজনীতিতে কোনো প্রতিনিধি না থাকায় চাকরি-বাকরিতেও পিছিয়ে মাধেসি মুসলিমরা।

এ অঞ্চলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড-বিরোধী একটি সংগঠনের নেতা আলম খান (২৮) জানান, মাধেসি অঞ্চলের লোকজন সব সময়ই উচ্চ বর্ণের নেপালীদের দ্বারা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শোষিত। ২০০৭ সালে মাধেসি সম্প্রদায়ের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছিল আলমকে। তখন মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হয় তাকে। বর্তমানে নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচারণার কাজ করেন আলম।

নেপালে মুসলিমদের অন্যতম প্রধান সমস্যা অশিক্ষা। মুসলিমরা, বিশেষ করে মুসলিম নারীরা এখানে এমনিতেই সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি। তার ওপর অশিক্ষা একটা অভিশাপ। দেশের মোট ৫৫ শতাংশ শিক্ষিত নারীর মধ্যে নেপালের মুসলিম নারীদের মাত্র ২৬ শতাংশ লিখতে-পড়তে জানে। ১২ শতাংশ তরুণী স্কুলের মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করতে পারে।

নেপালগঞ্জ জামে মসজিদের সাবেক সভাপতি আবদুল রহমান জানান, নেপালের সরকারি স্কুলগুলোর নিয়মের সঙ্গে অনেক সময় ইসলামি মূল্যবোধ খাপ খায় না। যেসব মুসলিম মেয়ে পর্দা প্রথা (হিজাব বা নিকাব পরা) পালন করতে চায় তাদের পক্ষে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না। স্কুলে তাদের ভিন্নভাবে দেখা হয়। এটাকে ‘মানসিক নির্যাতন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি।

২০১১ সাল পর্যন্ত নেপালে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করা মুসলিমদের সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ হাজার। ২০০৭ সালে অবশ্য আলাদা একটি মাদ্রাসা বোর্ড গঠন করেছে নেপাল সরকার। এখানে বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয় উর্দুতে। দেশটির বেশিরভাগ মুসলিম উর্দুতেই কথা বলেন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, গণিত, ইংরেজি এবং নেপালী ভাষা শিক্ষা দেবে যেসব মাদ্রাসা তাদের নিবন্ধিত করা এবং আর্থিক সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে এর প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও দেশটির দুই হাজার মাদ্রাসার অর্ধেকও সরকারি নিবন্ধন পায়নি।

সরকার যথেষ্ট সহায়তা দিচ্ছে না বলে জানান ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত মেয়েদের একটি মাদ্রাসার প্রধান বদর আলম খান। ২০০৬ সালে মাত্র ছয়জন ছাত্রী নিয়ে মাদ্রাসাটি শুরু করেছিলেন বদর আলম। বর্তমানে সেখানকার ছাত্রী সংখ্যা ৪০৬। আরো অনেকেই ভর্তি হতে চায় মাদ্রাসাটিতে। তবে অবকাঠামো এবং শিক্ষকের অভাবে তাদের ভর্তি করানো সম্ভব হচ্ছে না।

এসব সমস্যা সত্ত্বেও একটি উজ্জল ভবিষ্যতের আশা নেপালের মুসলিমদের। দেশটির রাজনৈতিক দল ইউনিফাইড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল’র (মাওবাদী) স্থানীয় নেতা আতহার হোসেন ফারুকি বলেন, ‘মধেস জেলায় বাস করা সত্ত্বেও এখানকার মুসলিমরা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। সংস্কৃতি, ভাষা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে আমাদের পরিচয় স্বতন্ত্র হওয়া উচিত।’

২০১৫ সাল থেকে কার্যকর হওয়া নতুন সংবিধানে প্রথমবারের মতো মুসলিমদেরও নেপালের জনগোষ্ঠি হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। চাকরিতে মুসলিমদের জন্য রাখা হয়েছে কোটা ব্যবস্থা। দেশটির সরকারি চাকরির এক শতাংশ মুসলিমদের জন্য বরাদ্দ থাকবে।

নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে এখন ইতিবাচক স্বপ্নই দেখে নেপালের মুসলিমরা। নেপালগঞ্জে তারা প্রতিষ্ঠিত করেছে মুসলিমদের কমিউনিটি রেডিও, স্কুল এবং অনেক দাতব্য সংস্থা। সেখানকার মুসলিমদের নিয়ে আশাবাদী ফারুকিও। বর্তমান জোট সরকারের শরিক তার দল। ফারুকি বলেন, নেপালের মুসলিমদের বৃহত্তর স্বার্থে লড়াই চালিয়ে যাবে তার দল ইউনিফাইড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল।



মন্তব্য চালু নেই