সিটি নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা

আসন্ন ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বাকি মাত্র ছয় দিন। এরমধ্যে সোম ও মঙ্গলবার নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সুশীল সমাজ। নির্বাচনকে ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার থাকা সত্ত্বেও এ হামলার ঘটনাকে বিশিষ্ট নাগরিকরা দুঃখজনক বলে মনে করেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন ও বিচারিক সংস্কৃতির জন্য তারা অবিলম্বে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।

এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে নির্বাচনের আগে ও পরে ৪দিন ঢাকা (উত্তর-দক্ষিণ) ও চট্টগ্রামে নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে সহায়তার জন্য সেনাসদস্যরা রিজার্ভ ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে থাকবে।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনার শাহ নেওয়াজ এ বিষয়ে বলেন, ‘২৬ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্র্রিল পর্যন্ত তিন সিটিতে সেনাবাহিনী ব্যবহার করব। ভোটের আগের দু’দিন, ভোটের দিন ও পরের দিন সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে রিজার্ভ ও স্টাইকিং ফোর্স হিসেবে ব্যবহার করা হবে। যখন দরকার হবে রিটার্নিং অফিসাররা তখনই তাদের ব্যবহার করতে পারবেন। যা দরকার তাই-ই করবেন তারা।’

ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, ডিসিসি নির্বাচন কেন্দ্র করে নিরাপত্তার ছক তৈরী করা হয়েছে। ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্বে পুলিশের পাশাপাশি থাকবে র‌্যাব, আনসার ও গোয়েন্দা সদস্য।

ওই সকল এলাকায় অন্তত দুই হাজার র‌্যাব ও আড়াই হাজার আনসার সদস্য মোতায়ন থাকবে। এরই মধ্যে ভোটকেন্দ্রগুলো তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- সাধারণ ভোট কেন্দ্র, ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্র ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্র। তালিকা ধরে এ ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্রগুলোতে রাখা হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরেই ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তাদের বিষয় খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। যে সকল সন্ত্রাসী কারাগার থেকে নির্বাচনী এলাকায় প্রভাব ফেলতে পারে তাদের অন্য কারাগারে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকার মহানগর পুলিশ।

এদিকে সোমবারে খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণায় হামলার ঘটনায় বিশিষ্ট নাগরিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিমত, এ হামলায় সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক দেখা দেবে। সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা বাড়বে। নারী ও তরুণ প্রজন্মের অনেক ভোটার ভোট কেন্দ্রবিমুখ হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী ভূমিকা প্রত্যাশা করছেন নাগরিকরা। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হলে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, ‘প্রকাশ্য দিবালোকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। টেলিভিশনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কারা হামলা করেছেন। সরকারের উচিত দ্রুত দোষীদের গ্রেফতার করে নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। অন্যথায় ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মতো সিটি নির্বাচনও সরকারের জন্য আরেকটি কলঙ্ক হয়ে থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ১২ ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগের এক নেতার মামলা প্রমাণ করে ওই সময় ঘটনাস্থলে আওয়ামী লীগের লোকজন ছিলেন। তারাই হামলা করেছেন। তাই এই হামলার দায় সরকার এড়াতে পারে না। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ও ভোটারদের আস্থা সরকার ও নির্বাচন কমিশনকেই ফিরিয়ে আনতে হবে।’

নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর দেখা যাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে কিনা। জনগণের আশঙ্কা দূর করতে হলে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে হবে।’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা নিন্দনীয়। হামলা যারাই করুক নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন এ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। কমিশনের উচিত দোষীদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া।’

সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা নারী ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে পারে। অনেকে ভোটকেন্দ্র বিমুখ হতে পারেন। এখন নির্বাচন কমিশনের উচিত ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলা নিন্দনীয় ও দুঃখজনক। আমরা এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন। নির্বাচন কমিশনের নীরব ভূমিকায় আমরা আরও বেশী উদ্বিগ্ন।’

তিনি আরও বলেন, “নির্বাচনের তো সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করছিল। কিন্তু রবিবার থেকে পরিবেশ ঘোলাটে হওয়া শুরু হল। সোমবার তো সরাসরি খালেদা জিয়ার গাড়িতেই হামলা হল। এর দায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না। উপজেলা নির্বাচনের সহিংসতার মতো আমরা সিইসির কাছ থেকে আর শুনতে চাই না, ‘আমরা দায়িত্ব নেব না’।”

ড. বদিউল আলম আরও বলেন, ‘এ হামলার ঘটনা সাধারণ নারী ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াবে। অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। তাই এখন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নির্বাচন কমিশনকেই ফিরিয়ে আনতে হবে।’

তবে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা অবশ্যই নিন্দনীয় ও অনভিপ্রেত। তবে এই ঘটনায় নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্ট হবে তেমনটা মনে করার কারণ নেই। কেননা, আমাদের দেশে নির্বাচনের সময় খুনাখুনির ঘটনাও ঘটে। যেটা এখন পর্যন্ত ঘটেনি।’

ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ আরও বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে পেট্রোলবোমায় মানুষের শরীর ঝলসে যাচ্ছিল, বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। এখন তো বরং শান্তির সুবাতাস বইছে। নির্বাচনের সময় এমন ঘটনা ঘটেই থাকে কিন্তু মানুষ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে না। ভোটাররা স্বপ্রণোদিত হয়েই ভোট দেন।’

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজধানীবাসী উৎসবমুখর পরিবেশে সিটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। এ জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ ও ডিবি নিরাপত্তার ছক তৈরী করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পুলিশের পাশপাশি ভোটকেন্দ্রে র‌্যাব দায়িত্বপালন করবে। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের শৃঙ্খলার জন্য আনসার মোতায়েন থাকবে।দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই