রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটের রকেট সার্ভিস

বর্ষা মৌসুম শুরুর প্রাক্কালে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে চলাচল কারী সরকারী রকেট স্টিমার সার্ভিস অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ রুটের ৪ টি প্যাডেল জাহাজই রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে এই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এ খাতে ব্যয়ের কোন কমতি নেই। ফলে সার্ভে মেয়াদ অতিক্রমের পরেও তা নবায়ন হচ্ছে না নৌযানগুলোর নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে।

এমনকি এসব নৌযান নিয়মিত ডকিং পর্যন্ত হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এ রুটের সবচেয়ে বিলাসবহুল ও নির্ভরযোগ্য নৌযান ‘পিএস অস্ট্রিচ’ গত প্রায় এক পক্ষকাল ধরে বিকল হয়ে ঢাকায় পড়ে আছে। প্রথমে নৌযানটির স্পীডআপ গীয়ারের অয়েল কুলার নষ্ট হয়ে যায়। পরে তা সংযোজন করে ট্রায়াল দেয়ার সময় মূল ইঞ্জিনের ফাই হুইলের সংযোগ স্থলের রাবার ডিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ যন্ত্রাংশ নতুন করে সংযোজন না করলে নৌযানটি সচল হচ্ছে না। গত কয়েক বছর ধরে এসব প্যাডেল জাহাজের কোন ‘জেনুইন পার্টস’ সংগ্রহ করা হচ্ছে না।

স্থানীয়ভাবে অতি নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সংগ্রহ ও সংযোজনেই কর্তৃপক্ষের আগ্রহ বেশী বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে ‘পিএস মাহসুদ’, ‘পিএস লেপচা’ ও ‘পিএস টার্ণ’ নামের অপর ৩টি প্যাডেল জাহাজ ছাড়াও বছরখানেক আগে ঢাকা-বরিশাল রুটের জন্য আনা ‘এমভি বাঙালী’ নৌযানটিকে ঢাকা থেকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত রকেট স্টিমার সার্ভিসে চালান হচ্ছে। তবে এমভি বাঙালী ছাড়া ৩টি প্যাডেল জাহাজের অবস্থাই যথেষ্ট নড়বড়ে। অপরদিকে এমভি বাঙালী মোটেই যাত্রীবান্ধব নয়। ফলে তাতে সাধারণ যাত্রীদের ভ্রমণে আগ্রহ কম। এ ব্যাপারে গতকাল সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীর সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, আমরা সবগুলো প্যাডেল জাহাজই বিক্রী করে স্ক্রাপ করব। ৮৫ বছরের পুরনো এসব নৌযান চালানো আর সম্ভবপর নয় বলে তিনি জানান। তার মতে এসব নৌযান চালান লাভজনক নয়।

বছরখানে আগে সংগৃহীত ‘এমভি বাঙালী’র সাথে আগামী সপ্তাহেই ‘এমভি মধুমতি’ নামের নতুন নৌযানও যুক্ত হচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে এমভি বাঙালী ও মধুমতি জাহাজ দুটি পরিচালন কতটুকু লাভজনক হবে এবং তা কতটা যাত্রীবান্ধব জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করেন নি। উল্লেখ্য, ১৯৩৮ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে ভারতের কোলকাতার ‘গার্ডেন রীচ শিপ বিল্ডিং ওয়ার্কশপ’-এ নির্মিত বিপুল সংখ্যক প্যাডেল স্টিমারের মধ্যে যে কয়টি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল, তা থেকে বর্তমানে এ ৪টি নৌযানই অবশিষ্ট রয়েছে।

এমনকি এসব নৌযান ১৯৭৮ সাল থেকে ৮২ সালের মধ্যে বেলজীয় সরকারের অর্থায়নে ও কারিগরি সহায়তায় খুলনা শিপইয়ার্ড ও নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডে আধুনিকায়ন ও পুনর্বাসন করা হয়। ‘পিএস মাহসুদ, পিএস অস্ট্রিচ ও পিএস লেপচা’তে বাষ্পীয় পদ্ধতির পরিবর্তে মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন সংযোজন করে হাইড্রোলিক গীয়ার সংযোজন করা হলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে তা মাত্র ৩ হাজার ঘন্টা করে চলাচলের পরেই বন্ধ হয়ে যায়।

ত্রুটিপূর্ণ হাইড্রোলিক গীয়ার পরিবর্তন এবং মেকানিক্যাল গীয়ার সংযোজনসহ ও আরেক দফা পুনর্বাসন করে ১৯৯৫-৯৬ সালে সেসব নৌযান চালু করা হয়েছিল। সে থেকে অদ্যাবধি ঐসব নৌযান যথেষ্ট নির্ভরতার সাথে চলাচল করলেও এক অদৃশ্য কারণে গত ২ বছর যাবত যথাযথ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ উদাসীন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অপরদিকে ২০০২ সালে পিএস টার্ণ জাহাজটিও খুলনা শিপইয়ার্ডে নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করা হলেও সাম্প্রতিককালে তার গীয়ার ও প্যাডেলের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। এমনকি সংস্থার কারিগরি পরিদফতরের ঊর্ধ্বতন মহল এসব নৌযান স্ক্র্যাপ করার কথাও বলছেন বারে বারে। ইতোপূর্বে বেলজীয় সরকারের অর্থায়নে আধুনিকায়ন ও পুনর্বাসনের তালিকাভুক্ত ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল জাহাজ ‘পিএস কিউই ও পিএস গাজী’ এক রহস্যজনক অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হবার পরে তাও নিলামে বিক্রী করে স্ক্র্যাপ করা হয়।

স্বাধীনতার পরে কয়েকটি আধা সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত হবার পরে বিআইডব্লিউটিসি অনুরূপ একাধিক প্যাডেল জাহাজ নিলামে বিক্রী করে স্ক্র্যাপ করেছে। অথচ এসব নৌযান এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্তির পর্যায়ে রয়েছে। উপরন্তু যেখানে ১৯৯৫-৯৬ সালে এসব নৌযান আধুনিকায়ন ও পুনর্বাসন হয়েছে, সেখানে তা চলাচলের অযোগ্য বলে বিক্রী ও স্ক্রাপ করার পাঁয়তারাকে ওয়াকিবহাল মহল দুরভিসন্ধিমূলক বলে অভিহিত করেছেন।

তবে এব্যাপারে সংস্থার বদলীর আদেশপ্রাপ্ত পরিচালক কারিগরি জানান, আমরা সবগুলো নৌযানই যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের মাধ্যমে সচল রেখে যাত্রী পরিবহনের চেষ্টা করছি।



মন্তব্য চালু নেই