স্ত্রী-সন্তান আর অতীতের দারিদ্র্য নিয়ে লেখা প্রকাশ করলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা। পৃথিবীর ব্যস্ত মানুষদের অন্যতম তিনি। সেকারণেই অনেক সময়ই পরিবারকে সময় দেয়াটা কঠিনই তার জন্য। কিন্তু বারাক ওবামা বলেছেন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেই বরং তিনি ভালো বাবা হতে পেরেছেন। সময় দিতে পারছেন তার পরিবারকে।
যুক্তরাষ্ট্রের লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ‘মোর’ এ প্রকাশিত হওয়া একটি নিবন্ধে তিনি কথা বলেছেন ব্যক্তিজীবনের সংগ্রাম, পারিবারিক সংহতি আর স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মানেই সারাক্ষণ সহযোগী, সাংবাদিক, গোয়েন্দা সংস্থাসহ অসংখ্য মানুষ আপনাকে সবসময় ঘিরে থাকবে। এটি এমন একটি বৃত্ত যেখান থেকে সহজে কোনো মুক্তি নেই।
কিন্তু ব্যক্তিগত সময়ে আপনি কাদের দ্বারা ঘিরে থাকবেন সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর আমি সত্যিই অনেক সৌভাগ্যবান যে আমি আমার ব্যক্তিগত সময়ে নারী দ্বারা বেষ্টিত থাকি। আমার স্ত্রী ও দুই মেয়ে, তারাই আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জন্যই আজ আমি এই অবস্থানে। আমার এই কঠিন কাজগুলোর পরে তারাই আমার আশ্রয়স্থল।
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে থাকেন যে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে পরিবারকে আমি ঠিকমত সময় দিতে পারি কিনা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে হোয়াইট হাউসে বসবাস আমাদেরকে যেকোনো সময়ের চেয়ে স্বাভাবিক জীবন উপহার দিয়েছে।
মালিয়ার জন্মের সময় সৌভাগ্যবশত আমি এবং মিশেল তিনমাস একসঙ্গে আমাদের মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পেরেছিলাম। কিন্তু এরপরই মিশেলকে তার কাজে ফিরে যেতে হয়। আমাকে শিকাগোর ল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় ফিরতে হয়। প্রায়ই আমাকে তিনদিন পর্যন্ত পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়েছিলো। আমার বাসা শিকাগোতে হলেও আমি রাষ্ট্রের আইনজীবী হিসেবে কাজ করার জন্য প্রায়ই আমাকে স্প্রিংফিল্ডে মিটিংয়ের জন্য উপস্থিত থাকতে হতো।
আমরা চাকরিজীবী হওয়াতে আমাদের বেশকিছু সুবিধা ছিলো। আমরা হয়তো বাচ্চাদের খেয়াল রাখার জন্য কাউকে নিয়োগ দিতে কিংবা বাইরে খাওয়া-দাওয়া করার সুযোগ পেতাম। আমাদের হয়তো অন্যান্য পরিবারের অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ছিলো না। কিন্তু তবুও আমাদের দুজনেরই অনেক ঋণের বোঝা ছিলো। অর্থাৎ আমরা যখন বিয়ে করি আমরা যেন একসঙ্গে দরিদ্র হতে শুরু করি। তাই আমরা বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি বিলের জন্যই খুব হিসেব করে খরচ করতাম। কারণ আমাদের শিক্ষাঋণ পরিশোধ করা থেকে শুরু করে আমাদের বেবিসিটারের টাকাও যেন ঠিকমতো দিতে পারি।
এতকিছুর চাপ অনেক সময়ই আমাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠতো। সাশা’র জন্মের পর মিশেল ও আমার পরিশ্রম অনেক বেড়ে যায়। মিশেল তখন বাসাতেই সম্পূর্ণ সময় দেয়া শুরু করে। তাই ঘরের বাইরের কাজগুলোর সম্পূর্ণ দায়িত্বই আমার কাঁধে এসে পড়ে। আমার তখন নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আমি যতই পরিশ্রম করি না কেন দিনদিন আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার দূরত্ব ঘটছিলো। আমাদের বোঝা শুধু বাড়ছিলোই। আর বেশিরভাগ বোঝাই পড়ত মিশেলের কাঁধে যেমনটা প্রত্যেকটি পরিবারেই হয়।
তবে আমরা সৌভাগ্যবান যে আমার শাশুড়ি মারিয়ান সেসময় আমাদের অনেক সাহায্য করেন। তিনি আমাদের বাড়ির খুব কাছেই বাস করতেন। তাই প্রায়ই তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের সাহায্য করতেন। কিন্তু তবুও মিশেলের উপর অনেক চাপ ছিলো এবং সে বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলো।
আমি যখন সিনেটর নির্বাচিত হই তখন পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে যায়। আমাকে প্রতি সপ্তাহেই ওয়াশিংটন যেতে হতো। প্রেসিডেনশিয়াল ক্যাম্পেইনের সময় আমাদের জীবন একদমই ওলোট-পালট হয়ে যায়। তখন আমাকে বেশিরভাগ সময়ই রাস্তায় থাকতে হতো। মিশেলের উপর তখন আরো চাপ বেড়ে যায়। সময় যেতে যেতে তার বোঝার পরিমাণও বাড়তে থাকে।
এজন্যই আমি তাকে আমাদের পরিবারের স্তম্ভ বলি। কারণ সে সত্যিই তাই এবং সবসময় তাই ছিলো।
এখনও আমি সত্যিই জানতাম না যদি আমি প্রেসিডেন্ট হতে পারি তবে কি করবো। আমরা জানতাম পরিবারে আমি অনেক কমই দিতো পারবো। আমরা জানতাম, মালিয়া এবং সাশাকে তাদের স্কুল এবং বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসাটা অনেক কষ্টের হবে। তাই আমরা মারিয়ানকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসি। কারণ আমি বা মিশেল তাদের সঙ্গে না থাকলেও মারিয়ান তাদের সময় দিতে পারবে।
কিন্তু আমরা অবাক হয়ে যাই যে হোয়াইট হাউসে আসার পরই আমরা সবচেয়ে বেশি সময় একসঙ্গে থাকতে পারি। আমার দুই মেয়ের জন্মের পর কখনোই আমরা পুরো পরিবার একসঙ্গে এতটা সময় কাটাইনি। প্রায় প্রতিরাতেই আমাদের একসঙ্গে থাকার সুযোগ হয়। আমি আর মিশেল দুজনই বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখাই। মালিয়ার টেনিস ম্যাচে কিংবা সাশার নাচের ক্লাসেও উপস্থিত থাকতে পারি আমি। সাশা আমাকে তাদের বাস্কেটবল দল ‘দ্য ভাইপারস’কে কোচিং করাতে সাহায্য করে। দলটি চ্যাম্পিয়নও হয়। সব বাবার মত আমিও তাদের ফলাফল নিয়ে খুবই চিন্তিত থাকি। যখন আমার মেয়েকে হিল পড়ে প্রথম প্রম নাইটে যেতে দেখি তখন পৃথিবীর সব বাবা’র মতো আমার মনও নার্ভাস থাকে।
কিশোরী মেয়েদের বাবা হওয়াটা সবসময় সহজ না কিন্তু তাদের সঙ্গে সময় কাটানো সবসময়ই সুখের। আমাদের চরম ব্যস্ততার দিনেও মিশেল এবং আমি পরিবারের জন্য একটু সময় বের করার চেষ্টা করি যেটা আমাদের করতেই হবে। যেমন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে আমি যত ব্যস্তই থাকি না কেন আমি সব কাজ ফেলে উপরে চলে যাই এবং পরিবারের সঙ্গে খেতে বসি। কখনোই এর কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। আমার সহকর্মীরা সবাই এটা জানে এবং জাতীয় পর্যায়ের জরুরি কিছু না হলে তারা আমাকে এসময়ে বিরক্ত করে না।
নিশাচরের মতো আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি এবং পরবর্তী দিনগুলোর জন্য কাজ করতে থাকি। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে ডিনারে আমার পুরো কাজটাই থাকে তাদেরকে ঘিরে। আমি সাশা এবং মালিয়াকে আদর্শ বাবার মতো চিরাচরিত প্রশ্ন করে বিরক্ত করতে থাকি। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি যে তাদের স্কুল কেমন ছিলো কিংবা তার বন্ধুদের কি খবর, হোমওয়ার্ক করেছ কিনা? কিন্তু তারা উত্তরে আমাকে আমার বড় কান এবং পোশাক নিয়ে মজা করতে থাকে। আর মিশেলও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
এখন তাদের এমন বয়স যে তারা সবকিছুই বোঝে। তাই প্রায়ই তারা আমাকে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করে। অন্যান্য তরুণের মতো তারাও পরিবেশ নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাদের প্রজন্মের সব তরুণদের মতো তারা বিশ্বাস করে সমাজে বর্ণ কিংবা লিঙ্গ বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাদের বয়সী যেকোন সাধারণ মেয়ের মতোই তারাও বেশকিছু প্রত্যাশা নিয়ে বড় হচ্ছে। তারা বড় হয়ে যেটা হতে চায় সেভাবেই বড় হতে পারছে। আমি শুধু তাদের চিন্তাগুলোকে নিয়েই ভাবি এবং বোঝার চেষ্টা করি যে তারা কতটা বুদ্ধিমতি ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। তাদেরকে চিন্তা করলেই বরং আমি আরো চাঙা হয়ে উঠি এবং নতুন লক্ষ্য খুঁজে পাই। বাবা হওয়া সত্যিই আনন্দের। আর সন্তানের কাছ থেকে বাবা ডাক শোনার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই।
সন্তানের সঙ্গে সময় বের করার ক্ষেত্রে মিশেলও তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। আর এটি একটি বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। যেমনটা আমি বলেছি সেই আমাদের পরিবারের স্তম্ভ। আমি জানি যাই ঘটুক না কেন, তারা সবসময়ই আমার পাশে থাকবে এবং আমিও তাদের পাশে থাকবো।
এখনকার সময়ে মেয়েগুলো প্রায়ই রাতের সময়টা মিস করে কারণ তারা স্কুল ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এবং অন্যান্য সব বাবা-মার মতো আমিও আমার মেয়ের কলেজে ভর্তি হয়ে দূরে চলে যাওয়া নিয়ে শূন্যতা অনুভব করি। স্কুল শেষে মালিয়া দূরে গেলে আমার টেবিলের একটি খালি চেয়ার দেখবো বলে আমি তো এখনই শিউরে উঠি। তাই যতক্ষণ সম্ভব আমি আমার পরিবারকে সময় দেয়ার চেষ্টা করি। এক ছাদের নিচে পরিবারের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তই আমি উপভোগ করতে চাই।
ফার্স্ট লেডি ন্যান্সি রেগান একবার লিখেছিলেন, ‘হোয়াইট হাউসের জন্য কোনোকিছুই আপনাকে প্রস্তুত করতে পারবে না।’ তিনি অবশ্যই ঠিক ছিলেন। কিছুই আপনাকে তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু আপনার পরিবার আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।
মন্তব্য চালু নেই