ভারতে পুরুষ যখন ধর্ষণের শিকার !

ভারতে ধর্ষণের প্রসঙ্গ আসলেই আমাদের চোখের সামনে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির চলন্ত বাসে মেডিকেল ছাত্রী নির্ভয়াকে গণধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের কথা মনে পড়ে।

ওই ঘটনার পর ভারতজুড়ে ধর্ষণবিরোধী এক অভূতপূর্ব বিক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আইনজীবিসহ নারী অধিকার এবং মানবাধিকার কর্মীরাও এতে রাস্তায় নেমে আসেন।

তথাপি ধর্ষণ শব্দটি দ্বারা প্রধানত কোনো নারীর উপর পুরুষের নৃশংস যৌন সহিংসতাকেই বুঝায়। কিন্তু পুরুষের উপর নারীর যৌন সহিংসতার বিষয়টি কখনোই আলোচনায় আসে না।

এমনকি কোনো পুরুষকে কোনো নারী ধর্ষণ করতে পারে সেটিই হয়তো বিশ্বাস করা হয় না। বিশেষত কোনো ভারতীয় পুরুষের পক্ষে এ ধরনের ধারণায় বিশ্বাস করাটা প্রায় অসম্ভবই বটে। কিন্তু বাস্তবতা হল- ভারতে শুধু নারীরাই নন বরং পুরুষরাও ধর্ষিত হন।

আর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে মানসিক, সামাজিক ও বিভিন্ন আইনী নিপীড়নের ইস্যুও। এমনটাই দাবি করেছেন ভারতের গণস্বাস্থ্য কর্মী উর্বশী প্রসাদ। দ্য হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।

উর্বশী প্রসাদ জানান, ধর্ষিত হওয়ার পর তা প্রকাশে পুরুষরা প্রথমেই মানসিক ও সামাজিক বাধার সম্মুখীন হন।

কারণ সমাজিকভাবে সাধারণত ধারণা করা হয় যে, পুরুষরাই ধর্ষণ করে আর নারীরা ধর্ষিত হয়। পুরুষরা ধর্ষিত হতে পারে না।

পুরুষরা শক্তিশালি। সূতরাং কোনো পুরুষ হামলাকারীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো সক্ষমতা তার আছে। একই কারণে কোনো নারী পুরুষকে ধর্ষণ করতে পারারও প্রশ্নই আসে না।

ফলে কোনো পুরুষ যদি ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ তোলেন তা হালে পানি পায় না। পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব বা সমাজের কেউই তা বিশ্বাস করেন না।

এছাড়া ধর্ষিত পুরুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো সংগঠনও নেই বললেই চলে। ধর্ষিত পুরুষরাও ধর্ষিত নারীদের মতোই মানসিক নিপীড়নের শিকার হন। কিন্তু বাধ্য হয়েই পুরুষদের চুপ থাকতে হয়।

সামাজিক কারণে অনেক সময় ধর্ষিত নারীদেরকেও চুপ মেরে যেতে হয়। তবে নারীর প্রতি সামাজিক ন্যায় বিচার ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি এখন আগের চেয়ে অনেক খোলামেলাভাবেই আলোচনা করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, পুরুষরাও যৌন নীপিড়নের শিকার হতে পারে- এই স্বীকৃতিটুকুও এখনো মেলেনি।

নারী অধিকার কর্মীরা নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের কারণ হিসেবে প্রায়ই বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোকাঠামোকে দায়ী করে থাকেন। পুরুষদের উপর নিপীড়নের জন্যও এই পিতৃতান্ত্রিক মনোভঙ্গিই দায়ী।

পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা কাঠামোতে ধারণা করা হয় যে নারী মাত্রই দূর্বল, ভঙ্গুর ও অরক্ষিত। সূতরাং ধরে নেওয়া হয় সে পুরুষের নিপীড়নের শিকার হওয়াটাই স্বাভাবিক।

কোনো পুরুষ যখন ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করে সেও তখন এই দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হয়। তাকেও তখন ‘পৌরুষহীন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এছাড়া ধর্ষিত হওয়াটাকে সে ‘উপভোগ’ করেছে বলেও তার অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সাধারণত মনে করা হয় যে, পুরুষ মাত্রই যৌন ক্রীড়ায় লিপ্ত হওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত। পুরুষের বেলায় ‘সম্মতি’ বলে কোনো ধারণা নেই।

পিতৃতান্ত্রিক মনোভঙ্গিতে যৌনতা হল এমন কর্ম যা পুরুষ কোনো নারীর উপর বাস্তবায়ন করে। কোনো পুরুষ বা নারী অন্য পুরুষের উপর যৌন নিপীড়ন চালাতে পারে তা পিতৃতান্ত্রিক মনোকাঠামো গ্রহণই করবে না।

এমনকি বিনোদ নামের এক ধর্ষিত পুরুষ ব্লগে লিখেছেন, ‘অনেক সময় কোনো নারী কোনো পুরুষকে ধর্ষণ করে সেই পুরুষের পৌরুষে আঘাত হানার জন্য; তাকে লজ্জিত করার জন্য!’

ভারতের ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনেও এ বিষয়ে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩৭৫ নম্বর সেকশনে পুরুষকে ধর্ষণের ভিকটিম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

তবে ৩৭৭ নম্বর সেকশনে একজন পুরুষ কোনো সমকামি পুরুষের যৌন নীপিড়নের শিকার হলে লঘু শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

কিন্তু সেটাকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। কিন্তু কোনো নারী যদি কোনো পুরুষকে ধর্ষণ করে সে ক্ষেত্রে আইনে বিচারের কোনো সুযোগ নেই।

উর্বশী প্রসাদ বলেন, পুরুষদের ধর্ষিত হওয়ার বিষয়টিকেও সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি আইনী স্বীকৃতিও দিতে হবে।

এজন্য আইনে সংস্কার আনার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর পরামর্শ দেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই