ডেনমার্কে তিমি হত্যার মহোৎসব
উত্তর ইউরোপের একেবারে শেষের দিকের দ্বীপপুঞ্জের নাম ফারো। ডেনমার্কের এই দ্বীপে এমন বিশেষ কিছু নেই কিংবা এমন কোনো দর্শনীয় স্থানও নেই যা পর্যটকদের টানবে। কিন্তু তারপরেও প্রতিবছর ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক পর্যটক খুব গোপনে এই দ্বীপপুঞ্জে আসেন। কিন্তু কেন এই গোপনে দ্বীপপুঞ্জে আসা? প্রতি বছর ফারো দ্বীপপুঞ্জে বেশ ঘটা করে পালন করা হয় তিমি এবং ডলফিন হত্যা উৎসব। ওই একদিনের উৎসবে কমপক্ষে কয়েকশ তিমি এবং ডলফিন হত্যা করে দ্বীপবাসীসহ আরও অনেকে।
প্রতিবছরের মতো চলতি বছরেও ডেনমার্ক সরকারকে এই কুৎসিত উৎসব বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে। ডেনমার্কের পক্ষ থেকে প্রতিবারই এই উৎসব বন্ধের কথা বলা হলেও আদতে এই বছরেও তিমি এবং ডলফিন উৎসবটি বন্ধ হয়নি। ডেনমার্ক ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশ ডলফিন এবং তিমি হত্যার সঙ্গে জড়িত। এই দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম জাপান। কোনো প্রকার উৎসব ছাড়াই প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক তিমি, হাঙর, কচ্ছপ হত্যা করে চলেছে জাপানবাসী। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনভারসেশন অব ন্যাচার নামক একটি সংস্থার দেয়া তথ্য মতে, প্রতিবছর শুধু ইউরোপেই মোট তিমির এক শতাংশ হত্যা করা হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরুর তিন মাসেই প্রায় ১৭ হাজার তিমি মাছকে হত্যা করা হয়েছে।
এই নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে এগিয়ে ডেনমার্কেন ফারো দ্বীপপুঞ্জ এবং জাপান। ফারো দ্বীপপুঞ্জে এই সংঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি শুরু হয় কয়েক মাস ধরে। মূল উৎসবের আগে দল বেধে দ্বীপবাসী নৌকা এবং ছোটো ট্রলারে করে সাগর থেকে তিমি এবং ডলফিনদের তারিয়ে নির্দিষ্ট খাড়িতে নিয়ে আসে। আর এরপরই শুরু হয় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। ছেলে-বুড়ো-তরুণ সবাই হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পরে তিমি হত্যায়। মাছেদের রক্তে সাগরের রংও পাল্টে যায়, অথচ এই রক্ত মেশা লাল পানিতেই চলে একদল মানুষের উল্লাস। বিভিন্ন মানবতাবাদী মানুষ এবং সংগঠন এই উৎসবকে বর্বরতা হিসেবে দেখছেন।
BLOODফারো দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৪৮ হাজার। এই কুৎসিত উৎসবকে নিজেদের কাছে বৈধ করার জন্য তারা অদ্ভুত সব যুক্তি দাড় করিয়েছেন এবং সেই যুক্তিগুলো লিখিত আকারে নির্দিষ্ট স্থানে সাটিয়েও দেয়া আছে। সেখানে লেখা আছে, ‘ক. প্রাপ্তবয়ষ্কদের অবশ্যই মাসে একবার পাইলট তিমির মাংস খেতে হবে, খ. বিশেষত নারী এবং মেয়েদের তিমির মাংস খেতেই হবে, গ. নারীরা যতদিন পর্যন্ত সন্তান ধারণ করতে চাইবেন তাদের অবশ্যই নিয়মিত তিমির ফুসফুস খেতে হবে, ঘ.তবে তিমির যকৃৎ এবং কিডনি খাওয়া যাবে না।’ শুধু তাই নয়, তিমি এবং ডলফিনের রক্তও বোতলজাত করে রাখা হয় পরবর্তীতে খাবার জন্য।
ফারো দ্বীপবাসীর বিশ্বাস মতে, তিমি এবং ডলফিন হলো ঈশ্বরের তরফ থেকে তাদের জন্য উপহার। দ্বীপবাসীর এই বিশ্বাস সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় শত বছর ধরে এই উৎসব পালন করে আসছে ফারোবাসী। ইউরোপের এই অংশে যখন খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার হতে শুরু করে তখন ভাইকিং মতাবলম্বীদের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই করতে হয় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারকদের। ডেনমার্কের এই অংশে খ্রিষ্টধর্ম তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি এবং ভাইকিং বিশ্বাস মতে আজও তারা সাগরকে তাদের রক্ষাকর্তা এবং সাগরের প্রাণীদের ঈশ্বরের তরফ থেকে দেয়া উপহার হিসেবে বিবেচনা করছেন তারা।
ফারো দ্বীপের মতো জাপানেও এমনিই একটি দ্বীপ আছে, যার নাম তাইজি। এই দ্বীপের বাসিন্দারা প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক হাঙর হত্যা করতো খাবারের জন্য এবং রপ্তানির উদ্দেশ্যে। কিন্তু একটা সময় গোটা দ্বীপ সংলগ্ন সাগর থেকে হাঙর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক বিপাকে পরতে হয় তাইজিবাসীকে। হয়তো খুব জলদিই একই পরিনতি বহন করতে হতে পারে ফারো দ্বীপবাসীকে। পাশাপাশি সমুদ্র হারাতে পারে তার বাস্তুসংস্থান শৃঙ্ক্ষল।
মন্তব্য চালু নেই