ফিরে আসছে তালেবান
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আফগানিস্তানের তালেবান গোষ্ঠিকে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। ১৯৭৮ সালে এক গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিষিদ্ধ বামপন্থী দল পিপল্স ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকেই দেশটির শাসকরা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে শুরু করে। তৎকালীন সময়ে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র দ্রুত পরিবর্তিত হওয়ায় এবং বেশ কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক সফল বিপ্লব হয়ে গেলে আফগানিস্তান নিয়ে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পৌছায় যুক্তরাষ্ট্র। কারণ ভৌগোলিক দিক দিয়ে আফগানিস্তান ইরান এবং চীনের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র। আফগানিস্তানে যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাব অধিক কার্যকরী হয় তাহলে ভারত সাগর থেকে মার্কিনীদের পাত্তারি গুটিয়ে নিতে হবে এই ভয়েই দেশটির তালেবান গোষ্ঠিকে গোপনে অস্ত্র এবং অন্যান্য সহায়তা দিতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সেসময় আফগান সরকারের বিরুদ্ধে সাদা পতাকা হাতে মুজাহিদিন নাম নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল তালেবানরা।
অথচ এই তালেবানদের বিরুদ্ধেই ২০০১ সালে যুদ্ধ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। টুইন টাওয়ার হামলার জন্য আলকায়েদাকে দায়ি করে এবং এই সংগঠনের প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে তালেবান গোষ্ঠি আশ্রয় দিয়েছে এই অজুহাতে আফগানিস্তানে হামলা চালাতে শুরু করে মার্কিন সেনাবাহিনী। টানা প্রায় ১৪ বছর আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে মার্কিন বাহিনী লড়াই চালায়। এসময় অসংখ্য মানুষ মারা যায় এবং অগুনতি মানুষ আহত অবস্থায় আফগানিস্তানের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে। দেশটির এমন একটা অঞ্চল খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটা মার্কিন বিমান হামলায় বিধ্বস্ত হয়নি। শেষমেষ ২০১৩ সালের দিকে তালেবান গোষ্ঠি শক্তিমত্তার দিক দিয়ে কিছুটা দুর্বল হয়ে যায় এবং ২০১৫ সালকে আফগানিস্তানে অবস্থানের শেষ বছর হিসেবে নির্ধারণ করে আরও এক বছরের জন্য দেশটিতে অবস্থান নেয় মার্কিন বাহিনী। দেশটির উল্লেখযোগ্য কিছু স্থানে অবস্থান নিয়ে তালেবানদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরা-খবর পড়ে জানা যাচ্ছে যে, আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল পুনরায় তালেবান বাহিনী দখল করে নিচ্ছে। মার্কিন বাহিনীর অনুপস্থিতিতে তারা এই শক্তি সঞ্চয় করেছে বলে অধিকাংশ গণমাধ্যমই অভিযোগ করেছে। কিন্তু মার্কিন বাহিনীর আগ্রাসনই কি আফগানিস্তানের ভবিষ্যত নির্মান করবে কিনা এমন কোনো বক্তব্য কোনো সংবাদ কিংবা বিশ্লেষণে নেই। দেশটির কৌশলগত প্রদেশ কুনার দীর্ঘদিন মার্কিন বাহিনী দখলে থাকার পর সম্প্রতি আবার তালেবান বাহিনী এই প্রদেশটি দখল করে নিয়েছে। স্থানীয় আফগান কমাণ্ডার হাজি পাঁচা জানান, ‘এখানে যখন আমেরিকানরা ছিল তখন তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য থাকতো যুদ্ধবিমান। কুনারের উপর দিয়ে ড্রোন বিমান উড়ে যেত। এরফলে তালেবানরা সবসময় ভীত থাকতো। আজ তারা যতটা সাহসী আগে ততটা ছিল না।’
গত দশকে যুক্তরাষ্ট্র কুনার প্রদেশে বেশ ভালোই বিনিয়োগ করেছিল। সেসময় তারা স্কুল এবং সেতু নির্মানের পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করেছিল। কিন্তু এখন সেই অধিকাংশ স্কুল এবং সেতুগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। কিছু স্কুল খোলা থাকলেও সেখানে নেই কোনো শিক্ষার্থী। হাসপাতালগুলোর একই অবস্থা। কুনারে বর্তমানে তালেবানদের কঠোর ইসলামিক শাসন চলার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা একপ্রকার ব্যাহত হচ্ছে।
তালেবানদের হাতে নির্যাতিত এক কুনারবাসী হাজি যারজান। কুনারের ভেতরের গাঞ্জাল ভ্যালিতে বসবাস তার। প্রতিদিন এখন কান্নাকে সাথী করে সময় কাটে যারজানের। প্রায় তিন মাস আগে তালেবানদের একটি অংশ তাদের গ্রামে হামলা চালালে তার একমাত্র মেয়ে মারা যায়। একদিন সকালে কালো পোশাক পরিহিত একদল মানুষ তাদের গ্রামে আসে এবং বিচারের নামে তারা গ্রামের সবাইকে জড়ো হতে বলে। তাদের পক্ষ থেকে একজন নেতা গোছের মানুষ একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বিচার করতে বসে এবং ২২ বছর বয়সী আদিবাকে ধরে আনতে তার দুই যোদ্ধাকে নির্দেশ দেন। ওই দুই যোদ্ধা আদিবাকে নিয়ে আসে, তখন আদিবা তার স্বামীর ঘরে ছিল। সেসময় আরও একজন পুরুষকেও তারা টেনে হিচরে নিয়ে আসে। যদিও যারজানের ভাষ্য মতে, মানুষটি ওই গ্রামের ছিল না। বিচারে আদিবাকে এই বলে দোষি করা হয় যে, আদিবা ওই অপরিচিত মানুষটিকে আশ্রয় দিয়েছিল। মাত্র দশ মিনিটের বিচারে ওই তালেবান কমাণ্ডার আদিবা এবং ওই মানুষটির মৃত্যুদণ্ড দেন। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে আদিবা এবং ওই মানুষটিকে হত্যা করা হয়।
কুনার প্রদেশের মতো আফগানিস্তানের আরও অনেক অঞ্চলে তালেবানরা নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আপাত ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন বাহিনীর অনুপস্থিতিতেই এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আসলেই কি মার্কিন বাহিনীতেই সমস্যার সমাধান হবে আফগানিস্তানের। যেহেতু তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতবান গোত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম, তাই সকল গোত্রের মধ্যকার আলোচনার ভিত্তিতেই সমস্যার সমাধান করা উচিত। দেশের আভ্যন্তর থেকে এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে, তাহলেই দীর্ঘমেয়াদী শান্তির দিকে যেতে পারবে আফগানিস্তান।
মন্তব্য চালু নেই